Wednesday, August 25, 2021

অতৃপ্তি (পর্ব ৮)

 সকাল ছয়টা পঁয়ত্রিশ মিনিট। মাতালের মত সারারাত ঘুমিয়েছি। রাতে তিন বার ঘুম ভাংছে। আতংকে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় নাকি সে ভয়ে। এই বুঝি পুলিশ এলো। দরজা ধাক্কাচ্ছে। হুড়মুড় করে উঠে দেখি কেউ নেই।

পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়া নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। হলে উঠার আগে যখন মেসে ছিলাম তখন এক ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। নাম- সালাম। আব্দুস সালাম। এই লোক বলতো সে জীবনে কখনো হলে উঠবে না। কারণ, পুলিশ হল থেকে নিরাপরাধ ছাত্রদের দলবেধে ধরে নিয়ে যায়। একবার মাদার বক্স হলে নাকি এরকম পুলিশি অভিযান হয়েছিল। একটা ব্লক থেকে দশ পনেরো জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরেছিল। এক বোকাসোকা ছেলে আবার বুদ্ধি করে টয়লেটে লুকিয়ে ছিল। পরে যখন ভেতর থেকে বুঝতে পেরেছে আর আশেপাশে পুলিশ নেই তখন বের হয়ে চিল্লায়ে উঠেছে।

‘ইয়া হু! সবাইকে ধরেছে, আমাকে ধরে নাই’।

আসলে পুলিশ তখনো যায়নি। সে পেছনে খেয়াল না করেই চিল্লানি দিছে। চিল্লানির পর সামনের বাকি ছেলেগুলোর পজিটিভ রেসপনজ না পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে পুলিশের দল দাঁড়িয়ে আছে। অফিসার তার আনন্দ দেখে কড়া চোখে হাবিলদারকে বললেন, এরেও গাড়িতে ওঠা।

আমাদের হলে রাতে অবশ্য পুলিশ এসেছিল। যে পুলিশটার সাথে কথা বললাম তাকে বেশ মার্জিত মনে হলো। কাউকে ধরেছে কিনা জানি না। রাতে দরজা ধাক্কাচ্ছিল। খুলে দিলাম।

ভাই আইডি কার্ডটা দেখি?

আমি বললাম- আরে ভাই, আবাসিক না হলে, হলে আছি কেন? আইডি কার্ড না থাকলে তো হলেই তুলবে না। 

বুঝলাম ভাই। তাও দেখান। উপরের নির্দেশ।

ইয়াকুব ঘুমের ভান ধরে উপর হয়ে শুয়ে আছে। পুলিশ দেখে ভয় পেয়েছে। ও আবার আন্দলনে স্লোগান দিয়েছিল। সেই ভয়ে হয়তো উঠছে না। ধরে নিয়ে যেতে পারে।

পুলিশ ভাইকে আমার আইডি কার্ড দেখালাম। পুলিশ ভাই বলল, ওই ভাইয়েরটাও দেখান। আমি ইয়াকুবের মানিব্যাগ থেকে ওর আইডি কার্ড বের করে দেখালাম।

পুলিশ সাহেব আইডি হাতে নিয়ে বললেন, শোনেন ভাই, এত রাতে মানুষের ঘুম ভাঙ্গানোর ইচ্ছা আমাদের নাই। আমাদেরও বউ আছে। সংসার আছে। একটু ঘুমাতে ইচ্ছা করে তাদের সাথে। কিন্তু এমন একটা চাকরি করি, দিন নাই রাত নাই, কারণে অকারণে ছুটে বেড়ানো। আর কথায় কথায় বলা, উপরের নির্দেশ। কিছু মনে করবেন না ভাই, ডিস্টার্ব করলাম। এটুকু করতে আমি বাধ্য।

ইয়াকুবের আইডি কার্ডটা হাতে দিয়ে পুলিশ ভাই চলে গেল পাশের রুমে। ধমাধম দরজায় লাথি মারছে। লাথি মারার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে পুলিশ ভাইয়ের দৃঢ় বিশ্বাস, আদুরে স্বরে দরজা ধাক্কালে এইসব চেংড়া ছেলেদের রাত আড়াইটার ঘুম ভাঙ্গাতে সকাল আটটা বাজবে শিওর।

এখন সকাল সাতটা পাঁচ মিনিট। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছি। ইয়াকুব ৬টা তিরিশে বাস ধরে বাড়ি গেছে। ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। কবে যে খুলবে তার কোন দিশা নেই। অনেক কিছু ব্যাগে ভরেছি। এখন বেশ ভারী আর পেটমোটা একটা ট্রাভেল ব্যাগের মালিক আমি। এত জিনিসপত্র আমার! অবাক লাগছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন থেকে ট্রেনের সঠিক সময় ৮.১৫মিনিট। এই ট্রেন আসে ৮.৪৫মিনিটে। আজ ৯ টা পার করবে।

শাহ মখদুম হল থেকে বের হয়ে সোজা স্টেশনের পথে হাটছি। পথিমধ্যে জোহা স্যারের সাথে দেখা হয়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম, স্ফুলিঙ্গের সামনে। স্যার আমার দিকে ঘাড় কাত করে বেশ লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছেন না। আমি শ্রদ্ধাভরে স্যারকে সালাম দিলাম। সালামের কোন জবাব পেলাম না। স্যার বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন। আমার থেকে চোখ সরাচ্ছেন না। আমিতো রাত জেগে চোখের নিচে কালি মাখানো, ঘর্মাক্ত-দূর্গন্ধযুক্ত টিশার্ট পরিহিত এক সাধারণ ছাত্র। যার বুক বুলেটে ঝাঁঝরা হলে ‘মেধাবি ছাত্র’ উপাধিতে বন্ধুদের চাঁদা তুলে বানানো নিম্ন মানের দুই একটা টানানো ব্যানারে কয়দিন অস্পষ্ট ছবি হয়ে শূন্যে ঝুলে থাকবো মাত্র। আমাকে দেখে স্যারের লজ্জা পাওয়ার কোন কারণ নেই। এটা শিল্পীর ভুল নিশ্চয়।

স্টেশনে ট্রেনের জন্য বসে আছি। এক পিচ্চি পত্রিকা বিক্রি করছে। দশ টাকা দিয়ে একটা পত্রিকা নিলাম। সমকাল। বিশ পাতার কাগজের সঙ্গে ষোল পাতার ম্যাগাজিন। পাঁচআল। শিরোনামে বড় অক্ষরে লিখা- ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ঘোষণা- পুলিশের লাঠিপেটা’। বিস্তারিত ৮নং পাতায়।

সেদিন খাওয়া শেষে চলে আসার সময় ইয়াকুব একটা গান শুনিয়েছিল। সে বলল, একটা গান মাথায় আসছে। থাম, সুর করে গেয়ে শোনাই।

বেশ দরদ ভরা কন্ঠে ইয়াকুব গানটা গেয়ে শোনালো। গানের কথাগুলো আমার ভালোই লাগল। বীথীরও ভালো লাগলো। গান গাওয়ার টাইমে বীথী ইয়াকুব ছাড়া অন্য কোন দিকে নজর ফেরায়নি।

পরে রুমে এসে দেখি হারামী গানটা বহুত আগে লিখে রেখেছে। আমি পড়ে মুখস্ত করে নিয়েছি। ইয়াকুবের দেয়া সুরে বসে বসে গানটা গাইছি।

শিশিরে রয়েছো তুমি

সূর্যালোকে হেসে কূল,

চিনিনি তোমাকে আমি

কেন হলো এমন ভুল?

 

তুমি তো সে হেসে বেড়াও

থেমে থাকা পটোফুলে,

চিকিমিকি জ্বলে তা যে

চান্দের ই আভাস পেলে।

 

খুঁজি যে তোমাকে আমি

ঝরণার ই কোলাহলে,

বয়ে চলে উষ্ণতা তার

পাহাড় হতে নদীর ঢলে।

 

তোমায় আমি খুঁজি যেথায়

ভ্রমর উড়ে হারায় কূল,

ঐ যে দেখো ফুটেছে কত

বাগান ভরে ঘাসফুল।

 

আমি যে তোমাকে খুঁজি

চাহিয়া আকাশেতে,

কত শত তারা দেখো

জুড়ে আছে তারি বুকে।

 

শিশিরে রয়েছো তুমি

সূর্যালোকে হেসে কূল,

চিনিনি তোমাকে আমি

কেন হলো এমন ভুল?

হু হু হু হু হু হু হু

হু হু হু হু হু হু হু

 

চিনিনি তোমাকে কেন?

আরো আরো আরো আগে...

এত কাছে ছিলে তুমি...

হু হু হু হু হু হু হু হু

 

চিনিনি তোমাকে আমি,

কেন হলো এমন ভুল?

এত কাছে ছিলে তুমি...

লা লা লা লা লা লা লা

৯.১৩ মিনিট। ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে। আমার হাতে রাজ্যের ভারি ব্যাগ।

চলবে...

No comments:

Post a Comment