ফেব্রুয়ারির শুরু। বেলা দশটা পঁয়ত্রিশ মিনিট। মিটিমিটি রোদ। তেমন শীত নেই। একটা শার্ট গায়ে দিয়ে থাকার মত পরিবেশ। সোয়েটার পরার প্রয়োজন নেই।
আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রশাসনিক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একা নই। কয়েক হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর সাথে। প্রশাসনিক
ভবনের প্রধান ফটকে বেশ দামি দামি কয়টা চায়না তালা ঝুলছে। শিক্ষার্থীরা এই তালাগুলো
ঝুলিয়ে দিয়েছে। কংক্রিটে খোদাই করে লেখা ‘প্রশাসনিক ভবন’ তার উপরে দুই কর্ণারে দুই
দিক করে দুইটি মাইক লাগানো। নিচে একপাশে একটা ভাড়া করা অর্ধভাঙ্গা রিক্সায় মাইকের মেশিনপত্র।
কংক্রিটের ছাদের নিচ থেকে মাইকে স্লোগান দেয়া হচ্ছে-
‘প্রশাসনের কালো হাত, ভেঙ্গে দাও-গুঁড়িয়ে
দাও।’
‘শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য, চলবে না-চলবে না।’
‘একপক্ষীয় শিক্ষা, মানি না-মানবো না।’
‘জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো।’
-এরকম টাইপ সব স্লোগান।
ভবনের ভেতরে কিছু
মানুষ দেখা যাচ্ছে। বাইরে আসার জন্য ছুটোছুটি করছে। তালা দেবার আগে ভেতরে ঢুকেছিল।
আটকা পড়েছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা এসেছেন। টিভিতে লাইভ খবর প্রচার করছেন।
ভালো একটা পজিশন নিয়ে কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের সারি করে সাংবাদিক ভাইয়েরা সামনে দাঁড়িয়ে
খবর প্রচার করছেন। সামনে ক্যামেরা ম্যানরা এদিক ওদিক ক্যামেরা ঘুরিয়ে ভিডিওচিত্র ধারণ
করছেন। আমিও এরকম এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছি। এই সাংবাদিক ভাই কোন টিভি চ্যানেলের বুঝলাম
না। বুঝার জন্য কাউকে জিজ্ঞাসাও করলাম না। কেউ হয়তো বলতে পারতো। খবর যে টিভিতে লাইভ
প্রচার হচ্ছে তা শুনেই খুশি। পাশের একজন কাকে যেন ফোন করে বলল, তেত্রিশ নম্বর চ্যানেলে লাইভ খবর দেখাচ্ছে। দেখতো, আমাকে দেখা যাচ্ছে কিনা? তেত্রিশ নম্বর হয়তো ওই এলাকার ডিশ সংযোগের চ্যানেল
নম্বর। এ নামে কোন টিভি চ্যানেল থাকার কথা নয়। সাংবাদিক ভাই মাইক্রোফোনে বেশ জোরে কথা
বলছেন।
‘আমি এখন রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের পাশে প্যারিস রোড সংলগ্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পেছনে
দেখছেন আন্দোলনরত কয়েক হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী। আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীর
সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি এখানে দল মত নির্বিশেষে সকল ধরনের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত
অংশগ্রহন রয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রাণের দাবি নিয়ে আন্দোলনে স্লোগান দিচ্ছে। আমি
পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি কোন একাডেমিক ভবন খোলা নেই। সব ভবনের প্রধান ফটকে শিক্ষার্থীরা
তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন,
প্রশাসনিক
ভবনের প্রধান ফটক তালা ঝুলিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ছেলেমেয়েরা স্লোগান দিচ্ছে’।
কিছুক্ষণ থেমে সাংবাদিক
ভাই আবার শুরু করলেন।
‘আপনি দেখছেন, আশে-পাশে আইন শৃংখলা বাহিনীর কোন উপস্থিতি নেই।
তাদের ছাড়াই শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ ভাবে আন্দলোন চালিয়ে যাচ্ছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, মাঝখানে ছাত্রীরা গোল হয়ে বসে আন্দোলনে স্লোগান
দিচ্ছে, স্লোগানে গলা মেলাচ্ছে। আর
ছাত্ররা তাদের ঘিরে গোল হয়ে আছে আর মূল স্লোগানের সাথে গলা মেলাচ্ছে। সকাল থেকে অনাকংখিত
কোন ঘটনা এখনো ঘটেনি। সবমিলিয়ে দারুণ শান্তিপূর্র্ণ একটি আন্দোলন চলছে’।
‘হ্যাঁ সোমা’।
সাংবাদিক ভাই লাইনের
সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে মাইক্রোফোনের তার গুছিয়ে অন্য দিকে চলে গেলেন। আমরা সারি ভেঙ্গে
আন্দোলনরতদের সাথে মিশে গেলাম। স্লোগানে গলা মেলানো শুরু করলাম।
এখন মাইকে ছন্দ বলা
হচ্ছে। কিছু ছন্দ গানের সুরে গাওয়া হচ্ছে। আমরা সবাই ছন্দের তালে গানের সুর মেলাচ্ছি।
হাতের তালি আর ছন্দ সুরে আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে থাকছে। এই ছন্দ মিলিয়ে গান গাইছে আমার
হাবাগোবা দোস্ত ইয়াকুব। আমার চরম রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আন্দোলনের মূল অংশে
স্লোগান দিতে গেছে সে। এই ছেলের সাথে যাদের সামান্যতম পরিচয় আছে- তারা সবাই একে 'বেকুব'
বলে
ডাকে। আমি অবশ্য কোনদিন বেকুব বলিনি। 'দোস্ত', বলে ডাকি। 'বেকুব দোস্ত'
বলে
ডাকার খুব ইচ্ছা হয়। কিন্তু হয়ে উঠে না। রুমমেট বলে হয়তো হয় না। একসাথে বেশি থাকা হয়
বলে হয়তো এরকম সম্বোধন ভেতর থেকে আসে না। বন্ধুত্বটা মনে হয় একটু বেশিই গাঢ়। বেশি বেশি
কোন কিছু ভালো না। আমাদের বন্ধুত্ব প্রায় একপক্ষীয়। গাড়ত্ব-অগাড়ত্ব সব ইয়াকুবের উপর।
আমার থেকে ওর উপর যা অনুভূতি তার সবটুকু সহানুভূতি। হয়তো ওর সরলতার জন্য, নয়তো বন্ধুত্বের জন্য।
যাই হোক, এই বেকুবের চট করে ছন্দ তৈরীর এক অসাধারণ ক্ষমতা
রয়েছে। যে কোন মূহুর্তে পরিস্থিতি অনুযায়ি ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে পারে। বিভিন্ন ছন্দ গানের সাথে মিলিয়ে সুর করে গাইতেও
পারে। ও ক্লাশ ফাইভের দুই জমজ বোনকে প্রাইভেট পড়ায়। একজনের নাম আঁখি আরেকজনের নাম সাখি।
একদিন ওর সাথে টিউশনি ঠিক করতে গেলাম। ও বলল,
তিনটা
বেজে গেছে। চল, ওদের পড়িয়ে তারপর
তোর টিউশনি খুঁজতে যাব। আমার অনেকগুলো খোঁজ আছে, টিউশনি পেয়ে গেলি বলে। আমি ওর সাথে বকবক শুনতে গেলাম। পড়ানোর
ফাঁকে নানা ছন্দ মিলিয়ে মেয়ে দু'টার সাথে বেশ মজা
করছে ইয়াকুব।
পড়ানোর মাঝে এক সময়
কী যেন লিখতে দিল দুজনকে। মেয়ে দুটো লিখা বাদ দিয়ে উদাস মনে বাইরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টির
দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াকুব ছন্দ মিলিয়ে বলল,
বাইরে হচ্ছে বৃষ্টি
দিচ্ছ তোমরা দৃষ্টি,
আমি কিন্তু ঠিকই দেখছি
খাতায় কী করছ সৃষ্টি।
মেয়েদুটো চট করে লেখায় মন
দিল। ইয়াকুব আবার ছন্দ মিলিয়ে বলল,
আঁখি আর সাখি,
পড়াশোনায় দিও না ফাঁকি,
দিলে ফাঁকি পড়াশোনায়
বিয়ে দিব দেখাশোনায়।
মেয়ে দুটো হেসে কুটিকুটি।
কয়েকজন ছেলেপুলে
গিটার, তবলা, বাঁশি,
ইত্যাদি
সখের সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসেছে। আনাড়ি হাতে বেসুরে বাজনা বাজছে। তবে ইয়াকুবের কণ্ঠ
এই বেসুরে বাজনার সাথে ভাল মিলছে। গানের সুরের প্রতি স্লোগান শেষে তবলার উপর হালকা
করে আঘাত করা হচ্ছে। স্লোগানের শেষটা তবলার আঘাতে সমাপ্ত হচ্ছে। ভালোই শ্রুতি মধুর
শোনাচ্ছে।
‘সাধের শিক্ষা বানাইলো মোরে বৈরাগী,
এখন আমি বসে বাজাই ডুগডুগি’।
‘ওরে ওরে হাওয়া থাম না রে,
শিক্ষা তো আমারে আর চায় না রে...
এখন আমি যেতে চাই তোর সাথে...’
এ সময় হঠাৎ করে হালকা
বাতাসও বয়ে গেল।
আমি দাঁড়িয়ে আছি
ভিসি স্যারের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রশাসনিক ভবনের দিকে আসা প্যারিস রোডের একেবারে শেষ
প্রান্তে। আমার পিছনে সিনেট ভবন। ডানপাশে জোহা স্যারের কবরকে ঘিরে গোলাকার ফুলের বাগান।
এটি প্রশাসনিক ভবনের একদম সামনে। এখানে মেইন গেট থেকে আসা দুটি রাস্তার একটি প্যারিস
রোডের সাথে মিলে গেছে আর আরেকটি ডানদিকে মোড় নিয়ে বাসস্ট্যান্ড এর সামনে দিয়ে চলে গেছে
শহীদ মিনারের দিকে। দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। ২টা বেজে গেলে ডাইনিংয়ে খাবার পাওয়া মুশকিল।
আমি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ের পথে হাটা দিলাম। ইয়াকুবও ভেতর থেকে বেরিয়ে এল।
রাত ১১টা। প্রচন্ড
ঘুম পাচ্ছে। দুপুরের পর ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের মারামারি
হয়েছে শুনলাম। লাঠি, রাবার বুলেট-পুলিশের
অস্ত্র। আর পোলাপানদের অস্ত্র- হলের ডাইনিংয়ের রান্নার খড়ি, রাস্তার ইট-পাটকেল।
এই মারামারি ক্যাম্পাসে
একদম সাধারণ ব্যাপার। একটু ভয়ংকর হলে ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। ছেলেদের
হল ৮টা আর মেয়েদের হল ১২টার মধ্যে খালি করার নির্দেশ। এত কথা না পেঁচিয়ে সরাসরি বললেই
হয়- ছুটি। বাড়ি গিয়ে যেন বলতে পারি ছুটি হইচে, বাড়ি আইচি। আর এরকম হলে বলতে হয়- মারামারি করে এসেছি। কথাটা
বলতেও খারাপ লাগে, শুনতেও খারাপ লাগে।
বাপ-মা ভাবে যে, কী জংলী হয়ে গেল
ছেলেটা! লেখাপড়া করতে ভার্সিটি পাঠালাম,
আর
বাড়ি এসে বলছে মারপিট করে আসলাম।
বিকেলে হালকা ঘুম
দিয়ে সন্ধ্যায় টিউশনিতে ছিলাম। ক্যাম্পাসের তেমন কোন খবর জানি না এখনো। শুধু মারামারি
হইছে, এইটুকু শুনেছি। টিভি রুমে
গেলাম খবর দেখার জন্য। পোলাপান পাক-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে ব্যস্ত। চ্যানেল পাল্টানোর
কোন সুযোগ নেই। আমি খবর দেখার আশা ছেড়ে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ইয়াকুব খেলা দেখে রাতে
ফিরবে। ওর জন্য দরজা খুলে রাখলাম। এর কাছে দরজা খুলে ঘুমিয়ে কোন লাভ নেই। লাগিয়ে ঘুমালে
তো হাঁকডাক করবেই আর খুলে ঘুমালেও এসে অনর্থক চিল্লাপাল্লা করে ঘুম ভাঙ্গাবে।
চলবে...
No comments:
Post a Comment