Wednesday, August 25, 2021

অতৃপ্তি (পর্ব ৯)

 গরম তেলে পাঁচফোড়ন ঢেলে দেয়ার শব্দ। চড় চড় চড় চড় চড়। ডাল রান্নার শেষ পর্যায়ে তেলানি দেয়ার সময় এই বিশেষ ব্যবস্থা চলে। পিঁয়াজ-রসুন তেলে ভাজতে ভাজতে যখন হালকা লাল হয়ে আসে তখন পিঁয়াজ-রসুনের সাথে গরম তেলে মুঠো করে পাঁচফোড়ন ছিটিয়ে দিতে হয়। ফড় ফড় শব্দে পুড়তে থাকে এই দ্রব্যটি। পোড়ার সময় বেশ সুগন্ধও ছড়ায়। পাঁচফোড়ন পুড়তে পুড়তে রসুন-পিঁয়াজ বাদামী রঙ হয়ে আসলে ডাল ঢেলে দিতে হয়। গরম তেলে ডাল ঢেলে দেওয়া মাত্র ফস করে একটা শব্দ হয়। এসময় ডাল, তেলে ভাজা রসুন-পিঁয়াজ আর পাঁচফোড়ন মিলে বাতাসে একটা গন্ধ তরঙ্গ ছড়ায়। রাস্তার পাশে বাড়ি হলে রাস্তার মানুষও টের পায়, ডাল রান্না হচ্ছে। পাঁচফোড়নের এই গন্ধের মত ডালের স্বাদটাও চরম লাগে। ঠাণ্ডা  হয়ে আসলে ডালের উপরে ভাজা রসুন-পিঁয়াজ সহ পাঁচফোড়ন মিশ্রিত একটা স্তর পড়ে। তেলতেলে লাগে। এই স্তরের টেস্টটা ভালো। তবে পাঁচফোড়নের কালিজিরা দাঁতের নিচে পড়লে তিতা লাগে। পাঁচফোড়নের মধ্যে আর কী কী উপাদান থাকে আমি জানি না। শুধু তিতা লাগে যেটা- সেটা কালিজিরা, তা জানি। বাকিগুলোর মধ্যে জিরা বাদে আর সবাই অপিরিচিত।

আমার মা অবশ্য পাঁচফোড়নকে বারোসাজ বলে। এই জিনিষের মধ্যে বারো রকম উপাদান থাকে। তাই এ বিশেষ নাম। মায়ের মতে, সবগুলা উপাদান যদি সঠিকভাবে বারোসাজায় থাকে আর তা দিয়ে যদি ডাল রান্না করা হয়, তো সেই ডালে চুমুক দিলে এক চুমুকে কেয়ামত চলে আসবে। তবে বারোসাজ দেয়া ডালে লবন পানি হলুদ সহ হিসেব করলেও বারো উপাদান পুরবে কিনা কে জানে? হয়তো বারোসাজ এখন আপডেট হয়ে তা বারো উপাদান থেকে পাঁচ উপাদানে পরিণত হয়েছে। পাঁচফোড়ন নাম নিয়েছে। শুধু ডালে চুমুক লাগিয়ে যদি কেয়ামত চলে আসে তো দুনিয়ার আর সব খাবারের কী হবে? ডালের টেস্টের পাশাপাশি আর সব খাবারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বারোসাজকে পাঁচফোড়নে আপডেটের প্রয়োজন আছে।

আজ ১৩ই মার্চ। শীতকাল শেষ। বসন্তের মাঝামাঝি সময়। আমি ইয়াকুবের বাড়িতে। বারান্দায় কাঠের পিঁড়িতে চেপে বসে আছি। পিঁড়িটা সাইজে ছোট, উচ্চতায় কম। বারান্দাও নিচু। এক ফিটের কিছু বেশি হবে। অস্বস্তি লাগছে। বারান্দার উচ্চতার জন্য নয়। পিঁড়ির উচ্চতার জন্য। মনে হচ্ছে, পিঁড়ি বাদে এমনিতেই পায়ে ভর দিয়ে দুই হাঁটুর উপর দুই বাহু রেখে হাত সটান করে দিয়ে বসলেও আরাম লাগবে।

আমি একটু আগে উঁচু পিঁড়িতে বসে ছিলাম। ইয়াকুবের মামি (একরামুল স্যারের বউ) নিচু পিঁড়িতে বসতে পারেন না। তিনি আমার থেকে কায়দা করে উঁচুটা চেয়ে নিলেন। রান্নায় সমস্যা হচ্ছে।

অজানা কারনে মামির গায়ে বেশ মেদ জমেছে। ওজনে একটু ভারী হয়েছেন। এটা-সেটা কড়াইয়ে তুলে দেয়া, টাইম মত কড়াইয়ের ঢাকনা খুলে নাড়াচাড়া করা, চুলায় খড়ি ঠেলে দেয়া- ইত্যাদিতে তাকে ঠেস দেয়া পিঁড়ি ছেড়ে পায়ে ভর দিয়ে বারবার উপুড় হতে হচ্ছে। গরমে তিনি বেশ ঘেমেও গেছেন। শহরে মামির কারেন্টের চুলা আছে। গ্যাসের সিলিন্ডার আছে। ফ্রীজ আছে। একবেলা রান্না করে তা ফ্রীজে রেখে বাসি করে সাতবেলা খান। তাকে বেশীরভাগ দিন বীথী বা বীথীর মা রেধে দেয়। রান্না নিয়ে এত আয়োজন, চুলায় সারাদিন ফুঁয়ানোর টাইম- মামির নাই। তার শরীর ম্যাজম্যাজ করলে জাজিম পাড়া খাটে শুয়ে রিমোর্ট হাতে তিনি বত্রিশ ইঞ্চি রঙ্গিন টিভিতে চ্যানেল পাল্টান। বিবিসি-সিএনএন চ্যানেলে ইংরেজিতে খবর দেখেন। স্টার প্লাসে হিন্দি ভাষায় সিরিয়াল, পেন্ড্রাইভে করে এনে কোরিয়ান ড্রামা, ইংলিশ মুভি- এসব দেখেন। ইয়াকুবদের বাড়িতে খড়ি ঠেলা চুলায় মামির রান্নার অভ্যাস নেই একদম। একটুতেই এসব রান্নাঘর ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে যায়। এখানে বিরক্তির শেষ নেই তার।

মামি রান্না ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে আমার পিঁড়ি খেয়াল করলেন। কাম নাই, কাজ নাই- অথচ তারটার থেকে উঁচু পিঁড়িতে আমি বসে আছি। মামি আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন, ইয়াকুব কই গেল? ছেলেটাকে একটা উঁচু পিঁড়ি দিতে বলতাম।

ভদ্রতা করে আমি নিজেই মামিকে পিঁড়িটা দিয়ে আসলাম। যখন দিতে গেলাম দেখি উনি উঁচু পিঁড়িটা নিয়ে তার উপর নিচুটা দিয়ে আরেকটু উঁচু হবার চেষ্টা করলেন। আমিও কায়দা করতে ছাড়লাম না। বললাম- মামি, ঐ পিঁড়িটা দেন- নিচে কাঠ লাগিয়ে আরেকটু উঁচু করে আনি। মামি আমার কথায় বেশ খুশি হলেন। তরকারি নাড়া অবস্থায় চামচ হাতে হলকা উঁচু হয়ে বললেন, টেনে নাও। আমি টেনে নিয়ে এসে বারান্দায় একটু সরে বসেছি। যেন দেখতে না পায়, আমি কী করছি।

ইয়াকুবের বাড়িতে মানুষ বলতে ওর মা একলা। বাড়িতে বসার জিনিষ- এই পিঁড়ি দুটো। ইয়াকুবের একলা মায়ের জন্য দুটো পিঁড়ি অনেক।

বারান্দার আরেক পাশে গরুর একটা চাড়ি সাজানো। শুকনো হয়ে আছে। এই চাড়িতে গরু ছিল প্রায় বছর তিনেক আগে। গরুটা ইয়াকুবকে ভার্সিটি ভর্তি করানোর সময় বেচে দেয়া হয়েছিল। গরুটা নিয়ে ইয়াকুবের অনেক স্মৃতি। আমাকে কয়েকবার শুনিয়েছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে মন খারাপ লাগলে আমাকে গরুটার গল্প শোনায়। মাথায় হাত বুলালে গরুটা থেমে যেত। গলা চুলকে দিলে ঘাড় সোজা করে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে যেত। একহাত মাথায় রেখে আরেকহাত দিয়ে গলা চুলকে দিলে চোখ বেয়ে পানি পড়তো। ইয়াকুব ছাড়া অন্য কেউ খাবার দিলে খেত না। ইয়াকুবের মা দিলেও না। গরুটার দেখ-ভালের জন্য ইয়াকুবের রুটিন করা ছিল। লাল কালিতে কাগজে লিখে ঘরের দেয়ালে বেশ উঁচুতে টানিয়ে রেখেছিল ইয়াকুব। রুটিনটা এখনো আছে। কালিটা শুধু হালকা হয়ে গেছে। আমি ঘরে ঢোকার পর খেয়াল করেছি।

ডেইলি রুটিন ফর মাই বয় (যদিও গরুটা বকনা)

সকাল ৬টাঃ গোয়ালঘর থেকে গরু বের করা (দুইটাই)।

সকাল ৬.০০-৬.১০টাঃ মাথায় হাত বুলানো+গলা চুলকে দেয়া (শুধু আমারটার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)।

সকাল ৬.৩০-৬.৪০টাঃ গোয়ালঘর পরিষ্কার করা (শুধু আমারটার অংশ)।

সকাল ৬.৪০-৭.০০টাঃ গোসল করানো (শুধু আমারটাকে)।

সকাল ৭.০০-৭.৩০টাঃ তাজা ঘাস কেটে আনা (দুইটার জন্যই)।

সকাল ৭.৩০-৭.৪৫টাঃ ঘাসের পানি ঝরিয়ে কুচি করা (দুইটার জন্য)।

সকাল ৮.০০টাঃ ঘাস খেতে দেয়া (দুইটাকে)।

সকাল ৮.১৫টাঃ পানি আর খৈল সহ দুই চাড়ি ভরে দেয়া।

সকাল ৮.২০-৮.৩০টাঃ নিজে গোসল করে স্কুলের জন্য রেডি হওয়া। ভাত খেয়ে মাই বয় থেকে বিদায় নেয়া।

মিস্টার ইয়াকুব

ক্লাস সেভেন

রোল নং- ৭।

 

ইয়াকুবের রোল নম্বরের ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। ক্লাস সেভেনে রোল নম্বর সাত। হাইফাই ভালো ছাত্র ছিলো না ইয়াকুব। গ্রামের স্কুলে পড়ে সাত রোল অনেক পিছে। শহরের স্কুল হলে রোল নম্বর কোন ব্যাপার নয়। সবাই ভাল ছাত্র। আমি ইয়াকুবকে তার স্কুল জীবনের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, আরে মামু বলিস না। ছোট বেলায় মা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দিল, সবার আগে আমি ভর্তি হইছিলাম তাই রোল হল ১। তারপর ক্লাশ টু তে গিয়ে ২। থ্রিতে ৩। ফোরে ৪। ফাইভে ৫। সিক্সে হলো ৬। এই ঘটনা যে ধারাবাহিকভাবে ঘটছে তা প্রথম বুঝতে পারলাম ক্লাস সিক্সে। ভাবলাম, বাহ ভালোইতো! প্রতি ক্লাশে এক এক করে রোল বাড়ছে। টাকা পয়সা বাড়লে মানুষ যেমন খুশি হয় আমি তার চেয়েও খুশি হলাম আমার রোল নম্বর বাড়া দেখে। স্যারকে বললাম- স্যার, আমার রোল নম্বর তো প্রতি বছর এক এক করে বাড়ছে। আমি কিভাবে আরো ভাল করতে পারি? স্যার আমাকে বললেন, আমি যত বেশি পড়ব আর পরীক্ষায় ভালো করব আমার রোল নম্বর তত বেশি কমবে। তারপর আমি পড়ালেখায় ঢিল দিলাম। আমার গরুর দিকে মনযোগ বাড়ালাম। ক্লাস সেভেনে হলাম সেভেন। এটাও একটা ভাগ্য বলতে পারিস। ক্লাস সিক্সে কোথা থেকে এক মেয়ে এসে ভর্তি হয়ে ক্লাস সেভেনে ফার্স্ট হয়ে গেল। যার রোল ৫ ছিল সে গেল আটে। নবম আসলো ছয়ে। আর আমি হলাম সেভেন। তার মানে মেয়েটা না আসলে আমার রেকর্ডটা ভেঙ্গে যেত।

রেকর্ড ভেঙ্গে যেত মানে?

মানে, আমি ক্লাস সেভেনেও ঘুরে ফিরে ষষ্ঠই হতাম।

তার মানে তোর রোল নম্বর ক্লাস এইটে আট, নাইনে নয় আর টেনে দশ?

ইয়েস।

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে হারামির রোল নম্বর যে কত ছিল সেটা আর জিজ্ঞাসা করলাম না। ওইটা আর এগারো-বারো হবার সম্ভাবনা নাই। আমি শিওর।

আর কলেজে ভর্তি হলাম রোল নম্বর হলো এগার। ফার্স্ট ইয়ার পরীক্ষা দিলাম। বারোতম হলাম।

তোর ইউনিভার্সিটিতে রোল নম্বর কত?

১৩।

 

ইয়াকুবের ভাষায়- গরুটা বিক্রির আগ পর্যন্ত তার এই রুটিনের তারতম্য হয়নি কখনো। ইচ্ছা ছিল গরুটা কোনদিন বিক্রি করবে না। সে তার জন্মদিন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ইয়াকুবের সাথে কাটাবে।

সে সময় ইয়াকুবের বাবা বেঁচে ছিলেন। অন্য গরুটার দেখ-ভাল তিনি করতেন। বাকিটার দেখ-ভাল করতেও তার কোন আপত্তি ছিল না। তবে ইয়াকুব নিজ থেকে বাছুরটার দায়িত্ব নেয়। তার বাপ ঠিকমত গোসল করান না। ঘাস কুচির সময় সাইজ বড় করেন। বাছুর গরুর বড় ঘাস খেতে সমস্যা হয়। ঠিকমত পানি দেন না। যত্ন করেন না। এরকম সব অভিযোগ তার বাবার প্রতি।

বারান্দায় আমি যে পাশে বসে আছি সে পাশটায় একটা রুগ্ন গরু দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ইয়াকুবেরটার মাম্মিজান। আমার দিকে চেয়ে আছে। এর দৃষ্টিটা পড়তে পারছি না। কোন নবী যেন পশুপাখির ভাষা বুঝতেন। হযরত সোলাইমান (আঃ)। আমি যদি বুঝতে পারতাম, গরুটা আমাকে বলছে- ঐ, তৃষ্ণা পাইছে পানি দে। আমি পানি এনে দিতাম। ঐ, ঘুরতে যাবো দড়িটা খুলে দে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বাঁধনটা একটানে খুলে দিতাম। এই গরুটা রুগ্ন-শুকনো। সর্বশেষ বাছুরটা জন্মের সময় মারা গেছে। তখন ইয়াকুব বাড়িতে ছিল না। সে বাছুরটাকে দেখেনি। বেশ আফসোস করেছে সে জন্য। বাছুর দেখতে না পেয়ে ইয়াকুবের আফসোসের কারন কী- আমি জানি না।

রুগ্ন এই গরুটা প্রতিদিন আড়াই লিটার দুধ দেয়। হাফ লিটার দুধের দাম গরুর পেছনে খরচ হয়। এক লিটারের দাম ইয়াকুবের জন্য বরাদ্দ। আর ৫০০মিলির দাম ইয়াকুবের মায়ের জন্য। বাকি ২৫০মিলি ইয়াকুবের মা জাল দিয়ে নিজেই খান। সর তুলে ঘি বানিয়ে ইয়াকুবের জন্য জমান। ইয়াকুব বাড়ি আসলে খায়। কিছু থাকলে সাথে করে নিয়ে যায়।

ইয়াকুবের গ্রামে প্রতি লিটার দুধের খুচরা দাম ২৫ টাকা। এক গোয়ালা নিয়মিত বাড়ি এসে গাই দুইয়ে দুধ নেয়। তাই ২০ টাকা লিটার দরে দুই লিটার ২৫০ মিলি দুধের দাম রাউন্ড ফিগারে ৪০ টাকা দেয়। মাঝেমাঝে দুধ একটু-আধটু কম হলেও গোলায়া পুরো ৪০ টাকাই দেয়। ভার্সিটি পড়ুয়া একটা ছেলে আছে বলে এটুকু সম্মানি পান ইয়াকুবের মা।

এই হিসেবে মাস শেষে ইয়াকুবের বাড়ি থেকে পাওয়ার কথা ৬০০ টাকা। কিন্তু কোনমাসে ইয়াকুবের মা ৫০০ টাকার উপরে পাঠাতে পারেন না। নিয়মিত গরুর দুধ হয় না। দুধ থেকে মাসে ইয়াকুবের জন্য ৩৫০-৪০০ টাকা বরাদ্দ হয়। হাঁস মুরগির ডিম বেচেও কিছু টাকা জমান ইয়াকুবের মা। সব মিলিয়ে মাস শেষে পাঁচশ টাকার একটা নোট বানাতে পারলেই মায়ের মুক্তি।

তার মায়ের ধারণা বিদেশ থাকলে ছেলেদের এক নোট আর মেয়েদের দুই নোট লাগে। তার যেহেতু ছেলে বিদেশ থাকে তাই সারামাস ধরে তিনি এক নোট জোগাড়ে ব্যস্ত থাকেন। চকচকে বা ময়লা। টাকার গায়ে ময়লায় কোন সমস্যা নেই, ইয়াকুবের মা জানে। ময়লায় যত সমস্যা যুবতী মেয়েদের গায়ে। বিয়ে দিতে গেলে টের পাওয়া যায়। তবে ছেড়া টাকা যে টেপ লাগিয়ে চালানো যায় এইটা জানেন না তিনি। পঞ্চাশ টাকাকে 'আদশো ট্যাকা', পাঁচশত টাকাকে 'আদ হাজার ট্যাকা' নামে ডাকেন এই ভদ্র মহিলা। আমার দিকে তাকিয়ে থাকা এই রুগ্ন গরুর দুধ, হাঁস-মুরগীর ডিম এক নোটের এই 'আদ হাজার ট্যাকা'র জোগানদাতা।

গত ধানের সিজনে ইয়াকুবের মায়ের ৫টা মুরগী বিষ খেয়ে মরেছে। কার জমিতে বিষ মাখিয়ে ধান বুনেছিল। মুরগীরা আনন্দ করে খেয়ে নেচে-গেয়ে বাড়ি ফিরেছে। সন্ধ্যায় ইয়াকুবের মা তাজা-তাজা মুরগী কোঁঠায় তুলেছেন। সকালে ডিম আনতে গিয়ে কোঁঠা খুলে দেখেন সব কয়টা মরে পড়ে আছে। পাশের বাড়ির নাকি পনেরো জোড়া কবুতর মরেছে একসাথে। সাথে তাদের ১১ জোড়া বাচ্চাকাচ্চা। বাপ মা বিষ খেয়ে এসে সেই খাবার বাচ্চাদের আদর করে মুখে তুলে খাইয়েছে। সব গুস্টিসুদ্ধ মরেছে।

ইয়াকুবের বাড়িতে মোট তিনটা ঘর। দুইটা শোবার ঘর। একটা ইয়াকুবের বাবা-মায়ের। আরেকটা ইয়াকুবের। আর অন্যটা হল গোয়ালঘর। গোয়ালঘরে পার্টিশন করে রান্নাঘর বানানো। রান্নাঘরের যে পাশে গরু থাকে সে পাশে শুকনো খড়ি চাপিয়ে রাখা হয়েছে। খড়ির বিপরীত পাশে রান্নার চুলা পাতানো। পূর্ব-পশ্চিম করে।

প্রতিটা ঘরের বারান্দার ছাউনি খড়ের। চাল টিনের। আর দেয়াল বন ঘাসের। গোবর মাটি দিয়ে লেপে দেয়া। দেয়ালের মাটিতে হালকা চিড় ধরেছে। তবে চকচকে। শোবার ঘরের খুঁটিগুলো বাঁশের হলেও গোয়ালঘরেরগুলো সিমেন্টের। বেশ মজবুত। মেঝে খরখরে। মনে হলো ইট পাড়া। বহুদিনের পুরনো ইট।

ইয়কুবের বাড়ি রাস্তার ধারে নয়। গ্রামের মেইন রাস্তা থেকে একটা পুকুর পার হয়ে বাঁশের ঝাড়। তার পাশ দিয়ে প্রায় ২০০মিটারের মত হেটে ডানে মোড় নিলে একটি পুকুর। এই পুকুর থেকে এক বিঘা ফসলী জমি পার হলে ইয়াকুবের বাড়ি। এই বাড়িতে আসার নিজস্ব কোন রাস্তা নেই। অন্য সব জমির আইল বেয়ে বাড়ি আসতে হয়। ইয়াকুবের বাবা গরীব মানুষ জন্য তাদের কেউ কিছু বলে না। বরং তাদের চলাচলের সুবিধার জন্য জমিগুলোর আইল একটু প্রশস্ত করে রেখেছে। আসার সময় সেটা খেয়াল করেছি। আশেপাশের আইলগুলো থেকে ইয়াকুবের বাড়ি আসার আইলগুলো একটু চওড়া।   

একরামুল স্যার বাড়িতে ঢুকলেন। স্যারের পিছে ইয়াকুব দাঁড়িয়ে। বাজারের ব্যাগ হাতে। ইয়াকুবের বাম হাতে বেশ বড় সাইজের একটা কাতল মাছ। দেড় কেজির উপরে ওজন হবে। খেজুরের পাতা কানকো দিয়ে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে শক্ত করে বাঁধা। এই গিট ইয়াকুবের দেবার সাধ্য নাই। মাছ বিক্রেতা বেঁধে দিয়েছে নিশ্চয়।

চলবে...

No comments:

Post a Comment