Friday, September 25, 2020

ঘোলাটে

দুজন দুদিক থেকে বগলের নিচ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ঘাড়ে সেঁটে উঁচু করে ধরে রেখেছে। মুখ দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে লালা ঝরছে। যেন এক মুঠো লাল রঙয়ের ছাঁচি মরিচ এইমাত্র গাছ থেকে তুলে কচমচ করে চিবিয়েছি। মুখের ভেতর আগুনের গোলা তৈরি হয়েছে। জিহ্বা সহ উপরের তালু ও মুখের ভেতরে দুই গালের মাংসে দাউ দাউ করে জ্বলছে। দুই ঠোঁট মিলে এই আগুন গাল, চোয়াল, থুঁতনি কোন কিছুতে লাগতে বাদ নেই। আমি যতটা সম্ভব দুই চোয়াল কোনরকম টেনে হা করে বাতাস নেয়ার চেষ্টা করছি। হা হওয়া মুখ দিয়ে ক্রমাগত ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে আর গরম বাতাস বের হচ্ছে। বাতাস ঢোকার সময় একটু আরাম পাচ্ছি, বেরুনোর সময় আগুন ফুলকি দিয়ে উঠছে। এখন ঝালের সাথে হালকা নোনতা স্বাদ পাচ্ছি। 

আমি দুই চোখের পাতা টেনে চোখ খুলতে চেষ্টা করলাম। চোখ পুরোপুরি না খুললেও আলো দেখার মত অবস্থা হল। আর অন্য সবকিছু ঘোলাটে। আমি স্থির হওয়ার চেষ্টা করলাম। ধীরে ধীরে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করল। গত বছর নানিকে যখন চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম, ডাক্তার সাহেব নানীর চোখের সামনে পাওয়ারের কাঁচ ধরে বললেন, কেমন দেখছেন নানী? নানি বলল, ঘুলা। ডাক্তার আরেকটা কাঁচ নিয়ে ধরলেন। নানি আবারো বলল, ঘুলা। আরেকটা কাঁচ ধরলেন। নানী বলল, সামান্য পরিষ্কার। ডাক্তার সাহেব কাঁচের বাক্স বদল করলেন। এই বাক্সের তিনটা কাঁচ পরিবর্তনের পর নানি বললেন, ফুলবানু জন্মের পর যকুন চোখ ঘুলা হইয়ে গেচিল, কিছু আন্দাজ করতে পারচিলাম না। সামনের কেডা কুনডা চিনতে পারচিলাম না। তকুন ফুলবানুক গামচায় জড়ায়ে সামনে আনার পর আমার চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হইলো আর তারপর দুনিয়ার সব ঝকঝকা হয়া ফুলবানুকে যেমুন লাল টুকটুকি দেকিচুনু ঠিক সিরকম দেকতে পাচ্চি। নানির মত আমার চোখও ঘোলাটে থেকে ধিরে ধিরে ঝাপসা হলো। তবে এখনো ফুলবানু খালাকে দেখার মত অতটা পরিষ্কার হয়নি।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবার হাতে কাঁচা বাঁশের একটা করে লম্বা লাঠি। চোর পিটানোর জন্য সব বাড়িতে বাঁশের লাঠি থাকে। বছরে কয়েকবার চুরি হলেও দুই একবার সেই চোর ধরা পড়বে কিনা তার যে কোন গ্যারান্টি নেই- সেটা লাঠিওয়ালা জানে। তাদের ধারণা এই লাঠি মাথার কাছে নিয়ে ঘুমালে চোর ঘরে ঢোকার সাহস পায় না। লাঠিগুলো মাথার কাছে নিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে তাদের বছরের পর বছর কেটে যায়। কটকটে পাকা বাঁশের হলেও বয়সের ভারে লাঠিগুলোতে ঘুণ ধরে যায়। বাড়ির গিন্নির খড়ির সমস্যা হলে সেই ঘুণে ধরা লাঠি এনে চুলায় ঠেলে দেয়। ঠিক এদিন রাতে অলৌকিকভাবে চোরের পায়ের শব্দে বাড়িওয়ালার ঘুম ভাঙ্গে। মাথার কাছে হাত দিয়ে লাঠি না পেয়ে চিল্লাতে থাকে। লাঠি কই, লাঠি কই? 

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কারো হাতে এমন ঘুণে ধরা পাকা বাঁশের পুরণো লাঠি দেখছি না। গ্রামের সব গিন্নি হয়তো একদিনেই তাদের লাঠিগুলো চুলায় ঠেলেছে। 

এই লাঠিরগুলোর বাঁশ আজ সকালেই ঝাড় থেকে কেটে আনা মনে হচ্ছে। গিরা থেকে বের হওয়া কঞ্চিগুলো বাঁশের গা ঘেঁষে তাড়াতাড়ি করে এবড়ো থেবড়ো ভাবে এক কোপে কাটা। কাটা কঞ্চিগুলো ছোট ছোট চোখে হা করে তাকিয়ে আছে। একটা লাঠির একপ্রান্ত ফাটিয়ে আলগুলোর মাঝখানে ছোট ছোট পিস পিস কঞ্চি গুঁজে দেয়া হয়েছে। আলগুলো চোঁখা করে বর্ষার ফলার মত আকৃতি দেয়া। হাত চালাতে একটু কমবেশি করলেই চোঁখা আলগুলো ফট করে কারো চোখেমুখে ঢুকে যাবে- এমন খচখচে ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। এ অস্ত্র দিয়ে সবশেষে আমার বুক বরাবর আঘাত করা হবে।

সকালের ঠাণ্ডাটা এখন বগলের নিচের অংশে অনুভব করছি। কিটকিটে। ঠ্যাং দুটো আছে দেখতে পেলাম। আমার দেহের সাথে তাদের সংযুক্তি এখনো অনুভব করিনি। ঘাড় সোজা করে তাকাতে পারছি না। শিরদাঁড়ায় হাড্ডিগুলোর অবস্থান আপাতত অনুভূতিহীন। উরুতে আঁকাবাঁকা অসংখ্য কালশিটে। হাঁটুর উপরে থেঁতলানো। বাম হাঁটুতে চকচকে সাদা হাড্ডি বের হয়ে আছে। ডান হাঁটুর থেঁতলানো চামড়ায় রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে। তলপেটের নিচের লোমশ অংশ উন্মুক্ত।


এইতো শুয়োর তাকাইচে- বলে একজন বগলের নিচ থেকে মাথা বের করে নিল।

তৎক্ষণাৎ ঘাড়ের নিচে একটা ঝটকা অনুভব করলাম। চিৎকার করলাম কিন্তু শব্দ হলো না। সাথে সাথে অপর পাশ থেকে আরেকটা আঘাত। কাঁচা বাঁশের লাঠি ঝড়ো গতিতে ঘাড়ের নিচটায় এসে আছড়ে পড়ল। আঘাতটা তেমন অনুভব করলাম না। তবে এক কোপে কাঁটা একটি কঞ্চি ঘাড়ের মাংসে পিচ করে ঢুকে বেরিয়ে গেল- বুঝতে পারলাম। আমি উপুড় হয়ে থেঁতিয়ে পড়লাম। চোখ আবার ঘোলাটে হয়ে গেল। নগ্ন গায়ে এলোপাতাড়ি আঘাতের ফট ফট শব্দ পাচ্ছি। গিরার কঞ্চিগুলো প্রতিটা বাড়ির সাথে শরীরের পশ্চাতদেশের মাংসে দ্রুত মুখ ঢুকিয়ে আবার বের করে নিচ্ছে।

মুখ হা হয়ে আছে। লালা ঝরা থামেনি। হাঁপানো কুকুরের মত লালা ঝরছে। নিঃশ্বাসের জন্য এখন মুখটাই ভরসা। নাক ভর্তি সর্দি ঝেড়ে ফেলার শক্তি পাচ্ছি না। জোরে জোরে কয়েকটা দম ফেলার পর মুখের সামনের ধুলাগুলো উড়তে শুরু করলো। খানিকটা আবার লালার সাথে মিশে মুখের সামনে কাদাকাদা হয়ে জমে গেল। দুজন এসে আবারো আমাকে আগের ভঙ্গিতে বগলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে উঁচু করে ধরলো। 

রাতে যখন গরু নিয়ে বের হলাম। বাড়ির কেউ জাগা পেয়েছে বলে মনে হলো না। মাঠে এসে দেখি সাতজনের বেশি। জাল দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। গরুর দড়ি ছেড়ে জান নিয়ে দৌড়ানি দিলাম। আমি আর গরু দুজনেই জালে আটকে গেলাম। সবাই মিলে গরুটাকে বের করল। আমি পেঁচিয়ে গেলাম। তারপর কেউ একজনকে বলতে শুনলাম, মার শালাকে। এলোপাতাড়ি মার শুরু হল। উপর থেকে ডান কাঁধে একটা বাড়ি পড়ল, আরেকটা মাথায়। তারপর চোখ খুলে দেখি কুয়াশায় ভর্তি আকাশের নিচে চিৎ হয়ে পড়ে আছি

কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমার হাঁটুতে কাঁটা ফুটাচ্ছে। একজন পায়ের তালুতে বসেছে। আরেকজন বুকের বামপাশে। তিনজন মিলে দুই হাতের আঙুল ধরে আছে। একজনের ভাগে পাঁচটা। সে একহাত পুরোটা নিয়ে বসেছে। আর বাকি দুইজনের ভাগে তিনটা আর দুইটা করে। এরা দুইজন আপন ভাই। ছোটবড়। বড় ভাই ধমক দিয়ে ছোটটার চেয়ে একটা আঙুল ভাগে বেশি নিয়েছে। কাঁটা ফুটাচ্ছে। আমাকে তাকাতে দেখে সবাই নানু নানু বলে দৌড় দিল। আমি তাদের নানুকে দেখার জন্য ঘাড় বাঁকানোর চেষ্টা করলাম। দুজন লোক এসে আমার পেটের উপর পাড়া দিয়ে গেল।

আবার দুজন এসে টেনে তুলে বসিয়ে দিল। সাথে সাথেই ঝড়ের বেগে আলাদাভাবে দুই লাঠির দুই বাড়ি একসাথে এসে আমার উপর আছড়ে পড়ল। একটা পিঠে আরেকটা মাজায়। বাড়ি দুইটা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করলে মণ দুইয়েক হতো। আমি আবার চিৎপটাং হব এমন সময় আরেকটা বাড়ি পড়ল মাথার উপরে। তারপর আবছায়া ভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

এই সময়টার মাঝে বাটিতে করে মরিচ বেঁটে এনে আমার মুখে পুরে দেয়া হয়েছে। দুই পাটির দাঁত নাকি শক্ত হয়ে আটকে ছিল। তাই মুখ খুলতে সুপুরি কাটা জাঁতি দিয়ে বেশ কসরত করা লেগেছে। আগুন গরম ঝালের মধ্যে নোনতা স্বাদের এই একটা ব্যাপার হতে পারে

আমার বামপাশে কাঁটা ফুটানো পিচ্চিগুলো এখন বেশ ভীতু চোখে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এই ভীতু চোখের কারণ আমি নই। ওদের দিকে যে আমার তাকানোর সাধ্য নেই, বুঝে গেছে। ওদের দৃষ্টি এখন আমার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশেষ বাচ্চার দিকে।

একজন লোক সেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল- ব্যাটা, তুমি পতিশোদ নিবে না? তুমার হাম্বার দড়িত এই শুয়োর হাত  দিচে।

লোকটার এই ব্যাটা বেঁটে গড়ণের। গোলগাল চেহারা। টুসটুসে গাল। ছোট ছোট চোখদুটো গালের মাংসের ঠেলায় ভিতরে ঢুকে গেছে। কপালের ডানপাশে সকালে ওর মা কাজলের কালি দিয়ে টিপ দিয়ে দিয়েছে। শীতের কারণে টিপের কালি আঠার মত লেগে আছে। ছেলেটির কোমরে গামছা জড়িয়ে নেংটির মত পরা। খালি গা। ড়ো বাছুরের মত থলথলে মাংসে ভর্তিবাচ্চাটার হাতদুটো গামছার ন্যাকড়ায় জড়ানো। ন্যাকড়ার মধ্যে দুই হাতের চার আঙুলের মাঝখানের তিন ফাঁকে লম্বা লম্বা তিনটি করে ছয়টি খেজুরের কাঁটা গাঁথা। হাতদুটি শক্ত করে মুঠো করা। কাঁটাগুলি এতটাই তরতরে যে, দেখে মনে হচ্ছে- চোরের গায়ে ফুটানোর জন্য সেগুলো বিশেষভাবে বাছাই করা হয়েছে। চোর ঘুমিয়ে আছে, ঘুম থেকে উঠলে তাকে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে- এমনটা বলে এতক্ষণ বাচ্চাটাকে থামিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিশোধের জন্য সে সকাল থেকে কাঁটা সংগ্রহ ও ফুটানোর প্র্যাকটিস করছে। কাঁটা ফুটানোর আগ্রহে যে তার একটুও ঘাটতি নেই তা হলফ করে বলা যাবে। এমন শীতেও ঘেমে আছে।

ছেলেটার চোখ আমার তলপেট বরাবর। নায়ক জসিমের মত দুহাত মুঠো করে ঘুষি মারার চেষ্টা করলে প্রতিটা ঘুষি ওর উচ্চতা অনুযায়ী আমার লজ্জাথান বরাবর পড়বে।

একবার ভাবলাম হাত দিয়ে লজ্জাস্থানটা ঢাকি। চোখ ঘুরিয়ে হাতের দিকে তাকালাম। হাত দুটো কব্জি থেকে মুচড়ে উলটো দিকে ঘুরে আছে। আঙুল নড়ানোর চেষ্টা করলাম। নড়ল না। কব্জির হাড় থেকে দুটো হাতই বিচ্ছিন্ন।

বাচ্চাটা আমার দিকে সোজাসুজি মুখ করে তাকিয়ে আছে। দুই হাত আরো শক্ত করে মুঠো করার চেষ্টা করছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। নিঃশ্বাসের সাথে তার বুক পেটের পেশী ক্রমাগত উঠানামা করছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। গায়ের থলথলে মাংস এখন এঁটেসেঁটে আছে। কাঁটাগুলো দিয়ে আমাকে আঘাত করতে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসার জন্য সে তার পায়ের পেশীতে শক্তি সঞ্চয় করছে। আঙ্গুলগুলো ধুলোর মধ্যে ঢেউয়ের তালে টিপটিপ করছে। প্রতিশোধের প্রজ্জলিত আগুন তার চোখেমুখে।

ছেলেটার মা নিশ্চয় প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তার বাচ্চাকে বই হাতে তাড়া করে বেড়ায়। আজ হয়তো তিনি আমার জন্য আরেক দফায় মরিচ বাটতে ব্যাস্ত

বাচ্চাটি তার বাম পা সামনের দিকে এগিয়ে নিল। পেছন থেকে আচমকা আমার মাথা ছুঁয়ে ঘাড় বরাবর লম্বালম্বি ভাবে আরেকটি বাড়ি পড়ল। চোখ দুটো আবারো ঘোলাটে হয়ে গেল।

অন্তরে আমি

বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি। খুলনা যাবো। এক পরিচিত আপুর বিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে আপুর সাথে সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। কিছুদিন রুমমেটও ছিলাম। বিয়ের দাওয়াতটা এমন যে, যেতেই হবে। দুনিয়াতে যদি কেয়ামতের আল্টিমেটাম হয়, সূর্য যথারীতী সকালে পশ্চিমে উঠে পূর্বে ভেসে যাচ্ছে এরকমও হয়- তবুও আজকের ডেটে আমাকে যেতে হবে। দাবীটা আপুর নয়। আন্টির। আমার উপর কী কারণে আন্টির এমন দাবী, অনুমেয় নয়।


আমার হাতে একটা ছোটখাটো ট্রাভেল ব্যাগ। আগামীকাল বিয়ে। শনিবারে ফিরবো। বেশি কিছু নেয়ার প্রয়োজন নেই। বিয়ে বাড়িতে সাজুগুজু করার জন্য একটা মেকাপ বক্স আর পরার জন্য একটা শাড়ী নিয়েছি। সাথে দুই সেট সালোয়ার কামিজ। হাফ লিটারের সেভেন আপের বোতলে এক বোতল পানি আর এক হালি কলা। কেনা পানি আমি খেতে পারি না। ফিল্টার পানি তেতো লাগে। বমি ভাব আসে। পেট ঘেটে উঠে। ৭-৮ ঘন্টার রাস্তায় শুধু হাফ লিটার পানি আর চারটে কলাতে সামাল দিতে পারবো না। বাস থেকে নেমে আরো কতদুর যেতে হবে কে জানে?


পাউরুটি কেনার জন্য রাস্তার অপর পাশের এক খুপরি দোকানে গেলাম। ভালো মানের পাউরুটি নেই। দুইটা ছোট ছোট রুটি আছে তাও গতকাল এক্সপায়ার ডেট শেষ হয়ে গেছে। দেখতে খারাপ লাগছে না। এক্সপায়ার ডেট দেখিনি এমন ভঙ্গি করে খেয়ে নিলে সমস্যা হবেনা। এই বাস স্টপে আর কোন দোকান খোলা নেই। কেন খোলা নেই কে জানে। রেল স্টেশন-বাস স্টপ এসবের আশেপাশের দোকানগুলো ২৪/৭ সার্ভিস দেয়। অথচ এখন সব গুলোই বন্ধ। শুধু আকবর হোটেল খোলা। ভাতের হোটেল। ভ্রাম্যমাণ মানুষগুলি এই হোটেলে চড়া দামে ভাত খায়।


মাথার উপরে কটকটে রোদ। পিচঢালা রাস্তায় রাজ্যের গরম। বড় বড় ট্রাভেল ব্যাগ হাতে বাসের অপেক্ষায় অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাইফাই জামাকাপড় পরা। সাহেব বাবু চেহারা বেশিরভাগের। ভাতের হোটেলের ভেতর থেকে চড়া দামে ভাত খেয়ে বের হচ্ছে অগণীত মানুষ। ঘুরে বেড়াচ্ছে টিকেট কালোবাজারি করা সব টাউট বাটপার। বড় বড় বাস এখানে এসে ব্রেক কষছে। জানালা দিয়ে বাচ্চারা, মহিলারা বাসের পেট্রোলের গন্ধে বমি করছে। মাথার উপরের সূর্য তার ইচ্ছামত রাস্তায় তাপ ঢেলে চলেছে। রাস্তাও সমান তালে সে তাপের বিকিরণ করছে। বাসগুলি ভদ্রলোকদের কিছু নামিয়ে দিচ্ছে, কিছু তুলে নিয়ে হুশ করে টান দিয়ে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা ক্লিয়ার করছে।


-আফা, দুইডা টেকা দেন। গরীব মানুষ।


সাত থেকে দশ বছরের বাচ্চা হবে। গোলগাল চেহারা। গলার স্বরে ভারত্ব আসা শুরু করেছে। আমার দিকে হাত টান করে এগিয়ে ধরে আছে। পা দুটো হাটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা। দু’হাত মুঠো করে তাতে ভর দিয়ে ছেঁচড়িয়ে ছেঁচড়িয়ে আসলো। দু’হাতের কনুই থেঁতলে আছে। চোখমুখে ধুলা জমে ঘামে ভিজে কাদাকাদা অবস্থা।

আমি পার্স থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে দিলাম।


-আফা নেন।

-কী নিব?

-টেকা ফেরত নেন। আমি তো দুই টেকা চাইলাম। আফনে পাঁচ টেকা দিলেন, তাইলে তিন টেকা ফেরত পাবেন।


একটু পর এই স্টপে আমি থাকবো না। দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকদের কেউ থাকবে না। থাকবে শুধু টাউট-বাটপার, রাস্তায় ছিটিয়ে পড়া কাঁচা বমি। আর উত্তপ্ত রাস্তার উপর ছেঁচড়িয়ে চলা অবহেলিত এই মানুষগুলো। সাথে তাদের হাতে গুঁজে দেয়া আমাদের বিরক্ত মুখের ভালোবাসা। গতিময় এই ভদ্র সমাজে প্রাপ্য তিন টাকা ফেরত নিতে, এখন দশ বছর বয়সী এক ভিক্ষুকের কাছে আমাকে হাত পাতা লাগবে। আমি এদিক ওদিক খেয়াল করলাম, কেউ আমাকে দেখছে না। শুধু আমরা একে অপরকে দেখছি।


আমি চিন্তিত চোখে আর ছেলেটা হিসেবে ভুল করেছে এমন ভঙ্গিতে!