Wednesday, August 25, 2021

অতৃপ্তি (পর্ব ৪)

আমি, বীথী আর ইয়াকুব। তিনজন বসে আছি কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের পেছনের বারান্দায়। সামনের অংশে ছেলে-মেয়েরা প্রাইভেট পড়ায়। লাইব্রেরির বারান্দায় বসার চান্স না পেলে এখানে এসে বসে। এমনভাবে বসে যে, মনে হয় জায়গাটা তারা ভ্যাট ট্যাক্স দিয়ে নিজের করে নিয়েছে। প্রতিদিন যে এক জায়গায় বসে- তা না। একেকদিন একেক জায়গায় বসে। যেদিন যেখানে বসে সেদিন সেখানের ট্যাক্স কেবল পরিশোধ করে আসলো- হাবভাব দেখে এরকমটা লাগে।

অনেকে প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় বিল্ডিংয়ের বারান্দাতেও বসে। একদিন দেখলাম, আট থেকে দশ জনের মতো পোলাপান গোল হয়ে বসে আছে। মন দিয়ে পড়ছে। আমি রাস্তা দিয়ে শের-ই-বাংলা হলের দিকে যাচ্ছিলাম। খাতায় ছেলে-মেয়েদের মনোযোগ দেখে মনে হলো সবাই অংক কষছে। হঠাত ছাদ থেকে বিরাট একটা দলা আকারে কংক্রীট খুলে ধড়াম শব্দে পড়ল তাদের বৃত্ত থেকে একটুখানি দূরে। ওই কংক্রীটের একপ্রান্ত সেখানে বসা এক মেয়ের মেঝেতে বিছিয়ে থাকা ওড়না ছুঁয়ে গেল। ছাদ থেকে পড়লেও কংক্রীটটা ভাংলো না। যেরকম পড়লো সেরকমই থেকে গেল। আমিতো থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রায় বিশ কেজির উপরে দলাটার ওজন হবে। খাতা থেকে মনযোগ তুলে কংক্রীটের দিকে তাকিয়ে তার সাইজ দেখে পোলাপানদের চোখমুখ কুঁচকে গেল। কোন রকমে সেখান থেকে উঠে তারা শহীদ মিনারের দিকে হাটা দিল। ওখানে কারো ভয় নেই। সেখানে মাথার উপরে বিশাল আকাশ আছে, তার উপর বিশ্বাস আছে। কমপক্ষে ভেঙ্গে পড়বে না। শুধু উড়ন্ত কাকের মল পড়তে পারে মাথায়। কয়েক মিলি আয়তনের এই কাকের মল বিশ কেজির কংক্রীট থেকে তো ভালো।

নজরুল মিলনায়তনের পেছনের বারান্দা পার্টিশন দেয়ালের মত দেয়াল দিয়ে ছোট ছোট খোপ খোপ টাইপ। আমরা এরকম এক খোপে বসে আছি। বারান্দায় আমার অবস্থানের ঠিক সোজাসুজি উপরে তাকালাম। আমাকে ঘিরে এই কংক্রীটের ছাদ সামনে-পিছে, ডানে-বামে মিনিমাম দু’হাত করে জায়গা দখল করে আছে। সেদিনের মত কিছু ঘটলে আমি একদম পিষে যাবো।

বীথী আর ইয়াকুব গল্প করছে। বীথী কে ইয়াকুব তার দেখা অদ্ভুত একটা স্বপ্ন গল্প করে শোনাচ্ছে। আমার ইয়াকুবের গল্পে কোন মন নেই। ওর দেখা কোন স্বপ্ন সিক্যুয়ালি হয় না। কী কী সব আজব ঘটনা দেখে, কোন আগা-মাথা থাকে না। এখন যে গল্প হচ্ছে সেটাও ওরকম। বীথী গালে হাত দিয়ে বেশ মনোযোগ সহকারে ইয়াকুবের গল্প শুনছে।

 

(গল্প)

স্টেশন বাজার থেকে আমি আর সজীব কোথায় যেন যাবো। ট্রেনে যাবো নাকি ভাবছি। একটা ট্রেন আসলো রাজশাহী স্টেশন থেকে। থামলো। স্টেশন বাজারে আবার রেললাইনের এক্সটেনশন হয়েছে। এই এক্সটেনশন অংশটুকু সোহরাওয়ার্দি হলের পচা পুকুরকে ঘিরে বেঁকে গিয়ে আবার মেইন লাইনের সাথে মিলেছে। যেন দুটো ট্রেন একসাথে আসলে দূর্ঘটনা না ঘটে। একটা ট্রেন এক্সটেনশনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। সোহরাওয়ার্দি হলটি স্বপ্নে অনুপস্থিত। এক্সটেনশন রেললাইনের অপর পাশে কী আছে তা দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন থেমে থাকার কারনে হয়তো। আমাকে সজীব বলল- চল, ট্রেনেই যাই। বাসে অনেক ভাড়া আর কষ্ট।

আমরা দু'জন ট্রেনে উঠার জন্য এগুচ্ছি আর ট্রেন ছেড়ে দিল। আমরা সেই বাঁকা লাইন দিয়ে ট্রেনের পিছে পিছে দৌড়াচ্ছি।

ট্রেনের ইঞ্জিন আর একটা বগি যথারীতি মেইন লাইনে উঠে গেছে। অপর দিক থেকে মুখোমুখি আরেকটা ট্রেন এসে সেটি স্লিপ করে লাইন থেকে পড়ে গেল। আর এক্সটেনশন লাইনের ট্রেনটি বেশ গতিতে সোজা লাইনে উঠে গেল। তার গা ঘেঁষে বিপরীত প্রান্ত থেকে আসা ট্রেনটি ইঞ্জিন সহ বগিগুলো নিয়ে পাশের পচা খাদে পড়ে ডুবে গেলো। আমি আর সজীব দুজনই লাইনে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখলাম। আমরা যে ট্রেনে উঠার জন্য দৌড়াচ্ছিলাম সেটি চলে গেল। আর পুকুরে ডুবে যাওয়া ট্রেনটির সব মানুষগুলা জানালা দরজা দিয়ে বের হয়ে পচা পানিতে হাবুডুবু খেতে লাগলো। এলাকার মানুষ সবাই তাদের বাঁচানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলো। দড়ি দিয়ে নিচ থেকে হাবুডুবু খাওয়া লোকদের উপরে উঠাতে লাগলো। সজীবও তাদের সহয়তা করার জন্য এগিয়ে গেল।

মূহূর্তেই রেললাইনের দু'পাশে কাদামাখা মানুষে ভরে গেল। যারা উপরে ছিল তারাও কাদা-পানি মেখে একাকার হয়ে গেল। কে যে ডুবেছিল আর কে যে উপরে ছিল বোঝা যাচ্ছে না। পুকুর থেকে মানুষ উঠে তারা আবার নিচে ডুবে থাকা মানুষদের সাহায্য করছে। যেন বাকিরা আর না ডুবে। সবাই চেষ্টা করছিল যেন কারো কোন ক্ষতি না হয়। আমার ও খুব ইচ্ছা ছিল যেন কাউকে নিচ থেকে নিজে হাতে টেনে তুলি। কিন্তু আমাকে সবাই কেন যেন এটা সেটা আনতে ব্যস্ত রাখলো। আমি নিজে হাতে কাউকে টেনে তুলতে পারলাম না। শুধু দেখলাম উপরের সবাই পচা পানিতে দড়ি নামিয়ে দিচ্ছে আর নিচের মানুষগুলি দড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে। যারা বেয়ে উঠতে পারছে না তারা শুধু দড়ি ধরে থাকছে, উপরের জন টেনে তুলছে।

সারাদিন এমন করার পর বিকেল বেলা দেখা গেল একটা ছোট বাচ্চা আর এক লোকের বৌ মারা গেছে।

বাচ্চাটিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বাচ্চাটি মরে গেলেও কেউ আফসোস করছে না। এমনকি তার মা-বাবাও না। সবাই বলছে এত বড় দূর্ঘটনা আর মাত্র দু'জন মারা গেল। হয়তো আল্লাহ এই দুইজনকে নিয়ে আরো হাজারো মানুষকে বাঁচালো। এতে কারো দুঃখ করা যাবে না। বাচ্চাটির মা-বাবাও মনে হয় সেরকম ভাবছে।  দুঃখ করছে না। তারা উপরে উঠার পর থেকে সারাদিন ধরে অনেককে সহায়তা করে এসেছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে পঞ্চাশের মত মানুষকে টেনে তুলেছে। বাচ্চার জন্য আক্ষেপ করলে তারা পঞ্চাশটা মানুষকে সাহায্য করতে পারতো না। তারা এখন ক্লান্ত। তবে আরো মানুষের সাথে পঞ্চশটা মানুষকে সাহায্য করতে পেরে তারা বেজায় খুশি। বাচ্চা মরে পড়ে আছে তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।

বউ মরা লোকটিও তাই। সারাদিন খেটেছে অন্যদের সহায়তা করতে কিন্তু নিজের বউটাই চাপা পড়ে মরেছে। লাশ নিয়ে বসে আছে। বাড়িতে খবর দিয়েছে। লোকজন এসে তাদের দু'জনকে নিয়ে যাবে।

সন্ধ্যা হলো। রাত হয়ে গেল। দূরের অনেক মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির পেছনে ফাঁকা মাঠে তাবু টেনে আশ্রয় নিয়েছে রাত কাটাবে বলে। এলাকার মানুষ তাবুতে তাবুতে খাবার ও পানি সরবরাহ করছে। আমি আর সজীব টিমটিমে আলোর তাবুগুলোর দিকে দূর থেকে তাকিয়ে আছি।

কিছুপর আমরা দু'জন তাবুতে তাবুতে ঘুরছি। লোকজনের সাথে গল্প করছি।

 

ইয়াকুবের স্বপ্ন শেষ হলো। হয়তো সেদিন সকালে আমি হাড়িপাতিল ঢুংঢাং করে ওর ঘুম ভাঙ্গায় ছিলাম। নয়তো আরো কিছু দেখতো। তবে ইয়াকুব স্বপ্নটায় আরো কিছু না দেখার জন্য আমাকে দোষারোপ করলো না। সে এটুকু দেখে তৃপ্ত। বীথীও আর বলল না, তারপর কী হলো?

 

আজ শুক্রবার। আমাদের এখানে আসার কারণ হলো, বীথী। সে, কী সব রান্না করেছে ছুটির দিনে। ইয়াকুবকে গত পরশুদিন বলেছিল- আগামী শুক্রবার সে ইয়াকুবকে কিছু রান্না করে খাওয়াতে চায়। ইয়াকুব যেন, না করে না। ও যে না করার বান্দা না সেটা আমি জানি। তার কাছে হয়তো ভদ্রতা দেখাবে এরকম ভেবেছিল বীথী। ইয়াকুবকে রান্না করে খাওয়াতে চাওয়া মাত্র সে ধাপ করে বলেছে- আমার রুমমেট আছে একটা। আমাকে খাওয়াতে হলে তাকেও খাওয়াতে হবে।

বীথী জিজ্ঞাসা করলো, ওই ভাইয়া কি অনেক খায়? ইয়াকুব বলেছে- না, স্বাভাবিকই তো খায়। তবে, সে কেমন খায় সেটা কেন জিগালে? এটা কোন প্রশ্ন হলো, বীথী?

বীথী বলেছে- না, ভাইয়া যদি বেশি খায় আর আমি যদি খাবার কম এনে পরে সর্ট পড়ে, তো? আগে থেকেই জেনে নেয়া ভালো না?

টিফিন বাটি খোলা হলো। খাবারের আইটেম- কবুতরের মাংস, তেলাপিয়া মাছ, ডালের সুরা, ডিম ভুনা আর বেগুনের চপ ভাজি। ভাত এনেছে পাতিলে করে। পরিমানে অনেক। আরাম করে খেলেও পাঁচজন খাওয়া যাবে। অথচ আমরা খেতে বসেছি আড়াইজন। দুইজন ছেলে একজন মেয়ে। ইয়াকুব খাবারের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে ঢোক গিললো। শালা যে আজ কী কুপানডা দিবে তা কবুতরের মাংসের বাটির দিকে তাকানোর স্টাইল দেখে বোঝা যাচ্ছে। হারামি আজ সকালে নাস্তা করেনি- বীথী খাওয়াবে বলে।

আমরা খাওয়া শুরু করেছি। বীথীও খাচ্ছে। তবে ও আমাদের দু'জনকে তদারকি করছে। পাতে ভাত কমে গেল কিনা, ঝোল শেষ হয়ে গেল কিনা- ইত্যাদি। আমি বীথী কে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা বীথী তোমার আব্বু-আম্মু কি জানে আমরা এখানে খাচ্ছি?

ভাইয়া, আসলে সত্য বলতে, জানে। তবে একটু অন্যভাবে।

কী রকম?

আমি বলেছি- আম্মু, আমরা বান্ধবিরা পিকনিক করছি। পাঁচজন। তুমি ভাল রান্না করতে পারো শুনে সবাই বলল তোমার রান্না খাবে। আমরা সবাই চাঁদা তুলে বাজার করে আনবো আর তুমি রেধে দিবে।

তাই নাকি? তো এসব বাজার করার টাকা কোথায় পেলে? চাঁদা তুললে কাদের থেকে?

টাকা লাগবে কেন? আম্মু বলল যে, তোদের কিছু কেনা লাগবে না। বাড়িতে কবুতরের বাচ্চা আছে আর পুকুর থেকে তোর বাপকে মাছ ধরে দিতে বলবনি। রেধে নিয়ে যাস।

, তাহলে আমরা এখন তোমার মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি?

বীথী ইতঃস্তত হয়ে বলল, আরে না। আম্মু রান্না করার টাইম কোথায় পাবে? আম্মু তো স্যারের বাড়ি রান্না করছে আজ। আব্বুও গেছে সেখানে। ম্যাডাম কাল ঢাকা গেছে। স্যার বাসায় একা। আব্বুকে ডেকে বলেছিলেন, রোজিনা আর বীথীকে নিয়ে কাল আসিস। ছুটির দিনে একটা ভুরিভোজ হয়ে যাক।

, আর তুমি ওখানে না গিয়ে এখানে ভুরিভোজ করছো?

জি ভাইয়া। ইয়াকুব তো আমাকে রান্নাবান্না নিয়ে খুব রাগায়। বলে, আমি নাকি রান্না করতে পারি না। তাই ভাবলাম একদিন দেখায় দি। কি ইয়াকুব, আর কিছু লাগবে তোমার?

(ইয়াকুবের সাথে বীথী ‘তুমি’ করে কবে থেকে বলা শুরু করেছে আমি জানি না। ইয়াকুব হ্যাঁ-না কিছু না বলে বাটি থেকে আরেক পিস মাছ তুলে নিলো)।

বীথীকে আমি যতটুকু দেখেছি তাতে চটপটে কোন মেয়ে বলে মনে হয়নি। একদম সরলমনা আর ভোলাভালা টাইপ। একটু রুক্ষ পরিবেশে গেলে আর মিশতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে মেয়েটা কথাবার্তায় বেশ পোলাইট।

বীথী আমাকে বলল, ভাইয়া জানেন, আমি না একটা কবিতা লিখেছি! ইয়াকুবের বাতাস আমার গায়ে লেগেছে। ও যদিও ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে পারে কিন্তু কবিতা লিখতে পারে না। শুনবেন আমার কবিতাটা?

বলো, শুনি।

আমি কিন্তু কবিতা লেখার কোন নিয়ম-কানুন জানি না। আগেই বলে নিচ্ছি ভাইয়া। পরে আবার দোষারোপ করবেন না।

আচ্ছা, বলো। দোষারোপ করবো না। আমি নিজেও কোন নিয়ম-কানুন জানি না।

তোমাতে আবেশী আমি

তোমাতে যে হারা,

তোমার প্রেমে যে আমি

এই তো পাগল পরা।

 

তোমার বুলিতে হারাই আমি

এ দুনিয়া ধারা,

তোমার চোখে দেখি আমি

মেঘের ভাসানো ভেলা।

 

তুমি চোখ মেললে দুনিয়া ভরে

নামে সূর্যের আলো,

কাঁদলে তুমি বর্ষায় হেলে

কদম ফুলের ডালো।

 

তুমি হাসলেই ভুলি যে আমি

হিমালয়ের চূঁড়ায়,

রাগলে তুমি গলে পড়ে তা

হয়ে ঝরণা ধারায়।

 

তুমি ছুঁটলে কাজল চোখে

প্রজাপতিরা পড়ে লজ্জায়,

রঙের বাহার কত আছে তাদের

মেলে দেখে তা ডানায়।

 

তুমি বললে মিশে যাই আমি

কাঠগোলাপের নকশায়,

হাঁটু গেড়ে বসে হৃদয়টা আমার

শুধুই তোমায় দিতে চাই।

 

তোমাতে হয়ে আবেশী

পড়েছি আমি লজ্জায়,

তোমাতে হারিয়ে আমি

রয়েছি পাগল পরায়।

এতো মেয়েদের উদ্দেশ্য করে লেখা। এটা তোমার কবিতা না। আমি শিউর। আর এত ফুল থাকতে কাঠগোলাপ কেন?

হি হি হি। ঠিক বলেছেন ভাইয়া। এটা আমার কবিতা না। এটা ইয়াকুব লিখেছে। আপনি হয়তো ইয়াকুবের কাছে আগেই শুনেছেন। তাছাড়া এত সূক্ষ ব্যাপার হুট করে ধরলেন কীভাবে? আর কাঠগোলাপ আমার পছন্দের ফুল। সেদিন ইয়াকুব জিজ্ঞাসা করল- তাই বলেছিলাম।

, আচ্ছা। আমাকে ইয়াকুব কোনদিনই কবিতা শোনায়নি। তবে ও বলেছিল একটা গান লিখেছে। আমাকে একদিন সুর করে গেয়ে শোনাবে। সুর বানানোর কাজ চলছে। এটুকুই।

ভাইয়া, ইয়াকুব আমাকে সুর করে গেয়ে এইটা গান বলেই শুনিয়েছে। একদম পচা সুর করেছে ও। গান লিখারও তো নিয়ম কানুন আছে। নিয়মের বাইরে গেলে সুর দিবে কীভাবে? আমার অবশ্য ভালো লেগেছে। কথাগুলা পছন্দ হয়েছে অনেক। আমি পুরোটা মুখস্ত করে ফেলেছি। দেখলেন তো এক দমে বলে দিলাম।

হুম, দেখলাম।

আসলে ভাইয়া, উপস্থাপনার একটা ভারত্ত আছে। বিড়ি খাওয়ার কোন উপকারীতা নেই। বিড়িখোরকে জিগাবেন, তুমি বিড়ি খাও কেন? এটা তো স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ! বিড়ি নিয়ে তার উপস্থাপন শুনলে জীবনে একবার হলেও বিড়ি টানতে ইচ্ছা করবে আপনার। আর দুধ বিক্রেতারা যদি দুধের উপকারীতা বিড়িখোরদের মত উপস্থাপন করতে পারতো- তবে দুধ কিনে খাওয়ার সাধ্য কার থাকতো? আসলেই কিন্তু, মোমবাতির আলোকে ক্যান্ডেল লাইট বললে মনে হয়- ভেজা চুলে কপালে টিপ পরে মাঝরাতে বরের অপেক্ষায় বসে আছি। ডিম ভাজিকে অমলেট-মামলেট বললে মনে হয়, কী না খাবো! ভাতের মাড়ে লবন মরিচ ডলে চাইনিজ স্যুপ বললে খড়ের ছাউনির কালিপড়া রান্নাঘরে থেকেও মনে হয় ফাইভ স্টার হোটেলে মেলামাইন চামচ হাতে বসে আছি। অমৃতে চুমুক লাগাবো! আমি এখন ইয়াকুবের উপস্থাপনার গ্যাঁড়াকলে পড়েছি। ও যা বলছে তাতেই মন ভুলে যাচ্ছে। যেন, মাঝরাতে ক্যান্ডেল লাইট জ্বেলে বসে আছি, কোন সুপুরুষের আগমনের অপেক্ষায়। ক্যান্ডেল লাইটে ওকে যে কেমন লাগবে? আমি নিজে অবশ্য ইংরেজিতে কয়টা লাইন লিখেছি। কোন নিয়ম কানুন ছাড়া লিখা। জানি না কবিতা হয়েছে, নাকি গান। ইয়াকুবকে এখনো শোনায়নি।

বলবো ভাইয়া?

বলো। আমি আবার ইংরেজিতে দূর্বল।

There is something I have,

but not in my hand.

I want to share

a little bit of warmth

and I can, give that just.

Please my heart,

believe just.

কী যে লিখলাম ভাইয়া। কত যে ভুল আছে। ভালো ইংরেজি জানে এরকম কাউকে দেখালে হতো। কিন্তু লজ্জা লাগে। প্রেমের কথা লিখেছি দেখলে কী ভাববে! আপনি কি বুঝেছেন কিছু?

সামান্য বুঝেছি। বলবো?

বলেন দেখি।

মানে, তোমার কাছে এমন কিছু আছে যা দৃশ্যত নয়। তোমার নিজের মালিকানাতেও নেই। আসল কথা তোমার কিছুই নেই। একদম শূন্য হাত। যা কিছু আর যেটুকু আছে তুমি কোন স্পেশাল কারো সাথে তার পুরোটাই শেয়ার করতে চাও। আর সেটা হলো তোমার ভালোবাসার উষ্ণ অনুভূতি। এজন্য সেই স্পেশাল কাউকে ব্যাপারটা শুধু বিশ্বাস করতে বলছো যে, তুমি তাকে ভালোবাসো এবং চিরকাল ভালোবেসে যাবে। তোমার সাধ্যের পুরোটা দিয়ে।

একদম সঠিক হয়েছে ভাইয়া। আমি এরকমই বুঝাতে চেয়েছি। কিন্তু ভাষাগত কোন ভুল আর গ্রামারে কোন ভুল আছে কিনা সেটা বোঝা অনেক কঠিন।

হুম, আমিও অতো ভালো ইংরেজি পারিও না, বুঝিও না।

তবে ইয়াকুবের সাথে থাকতে থাকতে আমিও কবি হয়ে গেছি। একটা কবিতা লিখেছিও।

বলেন কী ভাইয়া! শোনান না প্লিজ!

ঐ জোনাকির,

আলো,

ধুকুপুকু করে

জ্বলে, জানো?

 

ঐ বৃষ্টির,

পানি,

রিমিঝিমি ঝরে

শুধু জানি।

 

ঐ আকাশের,

তারা,

মিটিমিটি হাসে

শুধু দেখি।

 

ঐ চান্দের,

বুড়ি,

লাঠি হাতে বসে

বলে মারি।

 

ঐ পাখিটা,

গেয়ে চলে দেখো

শুধু তোমারি

প্রিয় গানগুলি।

 

ঐ কুয়াশায়,

যেন,

ঢেকে যায় কালো

মেঘগুলি।

 

ঐ গালিচায়,

দেখো,

গড়াগড়ি খায়

ফুলগুলি।

 

ঐ সাগরের,

বুকে,

ঢেউগুলি নাচে

কত মেলি।

 

ঐ নৌকা,

দেখো,

চলে কত জোরে

পাল তুলি।

ভালো হয়েছে ভাইয়া। আপনার কবিতার মধ্যে মিষ্টি প্রেম আছে।

এখানে আবার প্রেম কই পেলে?

না, মনে হচ্ছে, আপনি জিএফ এর সাথে ঘুরছেন আর তাকে সব মজার মজার দৃশ্য দেখাচ্ছেন।

জিএফ কী?

জিএফ বুঝলেন না? গার্ল ফ্রেন্ড এর সর্ট ফর্ম- জিএফ। এব্রিভিয়েশন বলতে পারেন।

, আচ্ছা।

ভাইয়া? আপনি নাকি খুব সাহসী? রাতে ভয়ংকর সব ভৌতিক স্বপ্ন দেখেন, অথচ ভয় পান না!

কে বলল তোমাকে? ইয়াকুব?

জি ভাইয়া, আপনার সাহসের কথা খুব গল্প করে। সেদিন আপনার ডায়েরিতে লেখা একটা স্বপ্ন নাকি ইয়াকুব চুরি করে পড়ে নিয়েছে। আমাকে শোনালো। আমিতো মুগ্ধ। এত সুন্দর স্বপ্ন আপনি দেখেন কীভাবে?

কোনটার কথা বলেছে তোমাকে?

ওই যে, রিয়া-নিলয়।

বীথী, ওইটা স্বপ্ন না, সত্যি। আর ইয়াকুব ওইটা চুরি করে পড়েনি। আমিই পড়তে দিয়েছিলাম।

বীথী ইয়াকুবের দিকে আড়চোখে তাকালো। ইয়াকুবের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই আমাদের কথায়। ও মনোযোগ দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। কবুতরের বাচ্চার ঠ্যাঙয়ের হাড্ডি চিবাচ্ছে।

বলেন কি? আসলেই সত্যি?

হুম।

রিয়ার ব্যাপারটা আপনারা কেউ বোঝেননি আগে?

না, এখনো কেউ জানে না রিয়া কেন এ কাজ করেছিল? এমনকি নিলয়েরটাও না। বাদ দাও এসব।

আচ্ছা বাদ দিলাম। আপনি কিছু মনে করলেন ভাইয়া?

না, ইটস ওকে।

আচ্ছা, আপনি আরেকটা এরকম সত্য ঘটনা শোনাবেন প্লিজ? আমি আপনার মুখে শুনতে চাই। ইয়াকুব ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে পারে ঠিক আছে, কিন্তু ভালো গল্প বলতে পারে না।

আর কোন সত্য ঘটনা নাই।

তাহলে স্বপ্নই বলেন, শুনি।

আমি গল্প শুরু করলাম।

 

(স্বপ্ন)

ডিপার্টমেন্টে বসে আছি। তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের চতুর্থ তলায়। ল্যাব এ। রাত ১১.৩০ মিনিট। জানুয়ারির সাত তারিখ। হাড় কাঁপানো শীত।

রিসার্চের কোন কাজে আটকে পড়া ছাড়া এত রাতে বিল্ডিংয়ে খুব কম পোলাপানই থাকে। নাইট গার্ড যারা থাকে তারা সন্ধ্যায় বিল্ডিঙয়ে বিভিন্ন তলায় ঘুরে ঘুরে আলো জ্বেলে দেয়। গার্ডরা রাত নয়টার আগেই নিচতলায় সিড়ির নিচে বিছানা-বালিশ পেতে নাক ডাকা শুরু করে দেয়।

আমি এখন রিসার্চের বিভিন্ন কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত। আমার আরো দুইটা পার্টনার আছে। রাতে থাকার প্রয়োজন হলে সবাই একসাথে থাকি। কাজ করি। অজানা কারণে আজ পার্টনারদের কেউ নেই। আমি একা এত রাতভর কাজ করতে চাইলাম না। একটা এক্সপেরিমেন্ট দিয়েছি সন্ধ্যায়। ঘন্টাখানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি দূর্ভাগ্যবশত অনেক সময় নিয়ে নিল। যেটা আমাকে সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত বসিয়ে রেখেছে।

আমি শুধু শুধু বসে না থেকে সেই এক্সপেরিমেন্টের পাশাপাশি আরো কিছু কাজ করে সেরে নিচ্ছি।

একটা প্ল্যান্ট এর কিছু স্যাম্পল শুকিয়ে রয়েছে। গবেষণার পরবর্তী ধাপে এগুলো গুঁড়ো করতে হবে। স্যাম্পল গুঁড়ো করার সময় প্রচুর ডাস্ট তৈরি হয়। দিনের বেলায় ল্যাব ভর্তি পোলাপান থাকে। এই ডাস্ট সবার জন্য বেশ অসুবিধের। এমনকি, যে গুঁড়ো করতে বসে সে নিজেও ধুলোবালি মেখে ভূতের মত হয়ে যায়। জামাকাপড় মাখিয়ে যায়। এই ডাস্টে- উপস্থিত অন্য সবারই  প্রবলেম হয়। বিশেষ করে এলার্জিক প্রবলেম।

গুঁড়ো করতে যে ব্লেন্ডার ব্যবহার হয় তা আবার ঘড়ঘড় শব্দে সবার মাথা খেয়ে ফেলে। চরম শব্দ দূষণ। দিনের বেলায় ব্লেন্ডারের শব্দ আশেপাশের কয়েকটা রুম থেকে শোনা যায়। আমি রাতের বেলা একা একা এরকম ফাঁকা ল্যাব পেয়ে গুঁড়ো করার কাজটা অনায়াসে সেরে ফেলতে পারি। অন্যান্য আরো কাজ শেষে এক্সপেরিমেন্টের কাজের পাশাপাশি রাত ১১টার দিকে ব্লেন্ডার সাজিয়ে স্যাম্পল গুঁড়ো করা শুরু করে দিলাম।

মুখে মাস্ক, হাতে কমদামি পলিথিনের গ্লোভস। লম্বা টেবিলভর্তি কাঠের ট্রেতে স্যাম্পল। টেবিলের এক কোণায় ব্লেন্ডার নিয়ে বসেছি মাল্টিপ্লাগের সকেটে ব্লেন্ডারের প্লাগ লাগিয়ে। ব্লেন্ডারের জগে স্যাম্পল রাখছি আর তার মাথায় ঢাকনা আটকে সুইচ টিপে ধরছি। ঘড়ঘড় শব্দে যেন পুরো রুম কাঁপিয়ে দিচ্ছে বেচারা ব্লেন্ডার।

ঘড়িতে এখন ১১.৪৫ মিনিট। অনেক পরিমাণ স্যাম্পল একসাথে নিয়ে বসেছি। রাত যখন হলোই তখন কাজটা একবারে সেরে যাই।

পাশে অন্য ডিপার্টমেন্টের আরেকটা ল্যাব আছে। ওই ল্যাবের পোলাপানও অনেক রাত পর্যন্ত থাকে। তবে ১০টার পর আর দেখি না কাউকে। আজও তারা নেই।

লম্বা বারান্দার দুই প্রান্তে দুইটা সিঁড়ি। একপ্রান্তের সিঁড়ি হতে আমাদের ল্যাবটা এক ঘর পরে। সিড়ি দিয়ে উঠলে হাতের ডানদিকে পড়ে। ১০-২০ কদম দুরুত্ব হবে। অন্য প্রান্তের সিঁড়িটা আমাদের ল্যাব থেকে প্রায় ৫-৭রুম পরে, ডানদিকে। অনেক দূরে। মেয়েদের পায়ের কদম হিসেব করলে দেড়শ’র বেশি হবার কথা। আমি ল্যাব থেকে বের হয়ে ল্যাব ও সিঁড়ির মধ্যকার সেই অল্প দুরুত্বের অংশটুকুতে পায়চারি করছি। রাত ১১.৫৭ মিনিট।

বারান্দায় পাঁচটা লাইট আছে। রাতে জ্বলে। আমাদের ল্যাবের সামনের দুটো লাইট কেটে গেছে। নাইট গার্ডরা লাইট জ্বালাতে এসে আমাদের প্রতিদিন বলে যায় অফিসে অভিযোগ দিতে। তারা অভিযোগ দিলে কাজ হয় না। ছাত্ররা একটা ঝাড়ি দিয়ে আসলে ১ ঘন্টার মামলা। তবে পোলাপানেরা যেহেতু রাতে সেরকম একটিভ থাকে না। তাই বারান্দার লাইট আমাদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্র্ণ নয়। বিধায়, যাবোনে মামা বলে পরে আর অফিসে কারোরই অভিযোগ দেয়া হয় না।

আমি পায়চারি করতে করতে সিড়ির কাছে এসেছি আর বিদ্যুৎ চলে গেলো। পুরো বিল্ডিং অন্ধকার। কুচকুচে অন্ধকার। নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, এরকম। হাতে গ্লোভস আর তাতে ডাস্ট লেগে যেন আরো ঘুটঘুটে হয়ে আছে। শীতকালে তো ক্যাম্পাসে কারেন্ট যায় না। এখন কেন গেল কে জানে। হয়তো লাইনে কোন সমস্যা হয়েছে।

আমি সিঁড়ির নিচে কয়েকজন মানুষের উপরে উঠে আসার ধুপধাপ শব্দ শুনলাম। যেন তারা ভারী কিছু নিয়ে বেশ দ্রুত উপরে উঠে আসছে। হাসাহসিও করছে। কন্ঠগুলো সব পুরুষ মানুষের। আমি ভাবলাম, হয়তো গার্ডরা হবে। বিদ্যুতের লাইনের গোলযোগও হতে পারে। অথবা কোন ল্যাব এর জন্য কিছু হয়তো আনছে। অথবা কোন স্যারের চেম্বারের চেয়ার টেবিল হবে। দিনের বেলা সময়-সুযোগ হয়নি, রাতে আনছে। তবে এত রাতে এগুলো আনার কোন যৌক্তিক কারন নেই। আর আনলেও নিচ তলায় রেখে দিবে, পরের দিন সকালে উপরে তুলবে।

আমি কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলাম সিঁড়ির নিচের দিকে। সবাই এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও সাবলীলভাবে চার তলায় উঠে আসলো। ওদের কারো কাছে আলো বা টর্চ নেই। সবার গায়ে ভারী জামাকাপড়। মাথায় মানকি টুপি। শুধু হাত আর মুখ দেখা যাচ্ছে। তিনজন পুরুষ মানুষ। দামাল বলা যেতে পারে। খেটে খাওয়া মানুষ। তবে সবার চেহারা যে কী পরিমান সুন্দর আর ফর্সা টকটকে তা বলে বোঝানোর নয়। চেহারাগুলো সব অপরিচিত। এই বিল্ডিংয়ে এর আগে যে এদের কাউকে দেখিনি এটা হলফ করে বলতে পারি।

ওরা আমাকে দেখে ভাই ভাই বলে চিল্লাতে লাগলো। খুব বিপদে পড়েছে এমন টাইপ।

আমি বললাম, কী হয়েছে ভাই?

একজন বলল, ভাই আমরা মেডিকেল থেকে এসেছি। খুব বিপদে আছি একটা ব্যাপার নিয়ে। এই বিল্ডিংয়ে নাকি ৪ তলায় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একটা ল্যাব আছে। সেই ল্যাব এ অনেক রাত পর্যন্ত ছাত্ররা থাকে।

আমি বললাম, জি। ঠিক শুনেছেন।

লোকটি বলল, ভাই আপনি কি প্রাণিবিদ্যার ছাত্র?

আমি বললাম, জি।

ভাই, আপনিই পারবেন তাহলে। আমরা আপনার কাছেই এসেছি। চলুন চলুন।

বলে আমাকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ল্যাবে ঢুকলো।

বলছে- ভাই, আমাদের কাছে পোস্টমর্টেমের একটা লাশ আছে। লাশটা একদম তাজা। এর দেহের অঙ্গগুলো কেটে নিতে হবে। কিন্তু মেডিকেলে ডাক্তারও নাই আবার যারা লাশ কাটে তারাও কেউ নাই। আমরা সাধারণ কর্মচারী। শরীরের ভেতরের কোনটা কী আমরা জানি না। জানলে আমরাই কেটে ফেলতাম। এক ডাক্তারকে ফোন দিলাম, বললেন- তিনি ঢাকা আছেন। পোস্টমর্টেমের জন্য মেডিকেলে কাউকে না পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে যোগাযোগ করতে বললেন। এখানের যে কোন ছাত্র-ছাত্রী অঙ্গগুলো চিনবে এবং আলাদা করে কেটে দিতে পারবে।

আমি বললাম, আমি অঙ্গ চিনি ভাই, কিন্তু এগুলো আলাদা করা আমাদের কাজ নয়। এটা ডাক্তাররা ছাড়া বুঝবে না। আমারা হিউম্যান বডির এনাটমীর উপর কোন প্র্যাক্টিক্যাল করিনি। কতটুকু কাটতে হবে আর কতটুকু রাখতে হবে সেটা ডাক্তাররা জানবেন। আমরা নই।

আপনি আশপাশ একটু বেশি করে রেখে কেটে দিবেন। তাহলে হবে। সার্জারীর সময় ডাক্তাররা ওটা ঠিক করে নেবেন।

এটা মেডিকেলের ছাত্রের কাছে নিয়ে যেতেন। তারা করে দিত। এখানে কেন?

 

হ্যাঁ, তাইতো? এখানে কেন? বীথী বলল।

আমি না থেমে বলতেই থাকলাম।

 

ভাই এত কথা বলার সময় নাই। যত দেরি করবো তত দ্রুত অঙ্গগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। আরেকটা রোগীর প্রাণ যাবে। ডাক্তার সাহেব আমাদের গালাবেন। তাড়াতাড়ি করেন। পরে সব কিছু খুলে বলছি। একজন টেবিলের ট্রেগুলো মূহুর্তের মধ্যে নিচে নামিয়ে সাজিয়ে ফেলল।

আমি বললাম, আপনাদের লাশটা কোথায়?

বলামাত্র একজন তার কাঁধ থেকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা বড় পুটলি নামালো। টেবিলে রেখে টান করে ছড়িয়ে দিল। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে লম্বা কিছু একটা আছে। একজন দুটা ধারালো ছুরি আর অপারেশনের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন সাইজের কয়টা কাঁচি বের করে আমার হাতে দিল। আমি বললাম, আলো ছাড়া কিভাবে কী করবো?

অমনি টেবিল পরিষ্কার করা মানুষটি পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে লাশের উপর আলো ফেলল।

ঝকঝকে সাদা এক মহিলার লাশ। একেবারে উলঙ্গ। মহিলাটি মধ্যবয়সী। ২৫-৩০ বছরের মধ্যে বয়স হবে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। সাদা কাপড়ে ঢাকা। চর্বি নেমে দেহের কোন অংশে এখনো ভাঁজ পড়েনি। টানটান বডি।

আমি বললাম, এ কাজ আমি কোনদিনই করিনি। কাটবো কিভাবে?

একজন বলল, বস! আমি উপরে কেটে দিচ্ছি আপনি শুধু ভেতর থেকে অঙ্গগুলো কেটে দেন। বলে কাঁচি নিয়ে লোকটি সুন্দর করে লাশটির পেট থেকে বুক সহ চিঁড়ে দিল। চামড়া সরিয়ে বের করে ফেলল ভেতরের অংশ। হার্ট আর ফুসফুস দেখতে পাচ্ছি। থেমে আছে। আমাকে কাঁচি দিয়ে বলল, বস কোনটা কী কেটে দেন এবার। আশপাশ একটু বেশি করে কাটবেন, তাহলেই হবে।

এই মহিলা মরলো কিভাবে? আমি বললাম।

বিষ খাইচে বস।

কন কী? সাংসারিক ঝামেলা?

আরে বিয়েই হয়নি এখনো। সংসার কই পেলেন?

তাহলে কী? প্রেম নাকি?

বস তাড়াতাড়ি কাটেন। বিষ ছড়িয়ে ওগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।

আমি বললাম, বিষ যা ছড়ানোর তা তো ছড়াইচে। আর সে জন্যে তো মরেও গেছে। এখন এই অঙ্গ নিয়ে কী হবে তাহলে? যার দেহে লাগানো হবে সে তো আবার মরবে।

সব বলছি, বস। কিছু হবে না। আপনি তাড়াতাড়ি এগুলো কাটেন।

আমি হার্ট, ফুসফুস আর লিভার কেটে দিলাম। তিনজন তিনটা হাতে নিলো। কিডনী কাটার জন্য ডানপাশে কাঁচি চালাচ্ছিলাম তখন সবাই অঙ্গগুলো নিয়ে দৌড় দিল। বলল, বস হইচে! আর লাগবে না।

 

আপনি সত্যি এভাবে মানুষ কাটছিলেন ভাইয়া? ভয় লাগছিলো না আপনার? বীথী বলল।

আমি হ্যাঁ-না কিছু না বলে গল্প বলতে থাকলাম।

 

লাইট যে ধরে ছিল সে একহাতে লাইট পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাতে লিভার নিয়ে দৌড় দিয়েছে। আমি ওদের পিছুপিছু দৌড়ে সিঁড়িঘর পর্যন্ত গেলাম। আরে ভাই লাগবে না তো লাশটা নিয়া যান। আমি লাশ কী করবো। ওরা ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি বেয়ে সবাই নামছে আর বলছে, আর কিছু লাগবে না বস। আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে। গেলাম আমরা। দেখতে দেখতে ওরা সবাই নাই হয়ে গেল।

আমি খুব বিষন্ন মুখে ল্যাব এর দিকে আসছি। প্রচন্ড অন্ধকার আর ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া অবস্থা আমার। দু'হাত রক্তে ভর্তি। ঠাণ্ডা রক্ত।

এই লাশ নিয়ে আমি এখন কী করবো? কাকে দিব? নাম নাই, পরিচয় নাই। তাছাড়া রুমে যত রক্ত আর আবর্জনা এগুলো পরিষ্কারই বা করবো কীভাবে? এসব চিন্তায় আমার মাথা ভারী হয়ে আসছে।

তাছাড়া যদি কেউ এমনভাবে লাশ দেখে, তাহলে আবার থানা কোর্ট হয়ে যাবে। আমি মানুষ মেরে অঙ্গগুলো কেটেকুটে কী করেছি, কোথায় রেখেছি- এসব প্রশ্নের উত্তর কী দিবো? পরে তো দেখছি মরা মেরে খুনের দ্বায়ী অবস্থা হবে আমার।

 

হি হি হি। বীথীর স্লো মোশনে হাসি।

 

আমি ল্যাবে ঢুকে অন্ধকারের মধ্যে ট্যাপের পানিতে হাতে মাখা রক্ত ভাল করে ধুয়ে নিলাম। যেন ল্যাবের অন্য কোন যন্ত্রপাতিতে হাত থেকে রক্ত না লাগে।

হাত ধুয়ে টেবিল পরিষ্কার করছি। এক প্রান্ত থেকে শুরু করেছি। আগে ডাস্ট পরিষ্কার করলাম। পরে লাশের ব্যবস্থা করতে হবে। ভাবছি ওই সাদা কাপড়টায় মুড়িয়ে বিল্ডিঙয়ের বাইরে লোকালয়ে লাশটা রেখে দিব। যেন সহজেই মানুষের চোখে পড়ে। পুলিশের হাতে গেলে একটা সুরাহা হবে।

আমি টেবিলের কর্ণার পরিষ্কার করতে গিয়ে লাশ শুয়ে থাকা সাদা কাপড়ের এক কোণা ধরে টানলাম। দেখি কাপড় চলে আসছে। মনে হলো, হয়তো এটুকু ঝুলে ছিল তাই আসছে। আমি আবার একটু টানলাম। দেখি কাপড় আবারো এগিয়ে আসছে। এখন যত টানছি তত এগিয়ে আসছে। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে কাপড়ের উপর লাশটা আর নেই। আমি উপুড় হয়ে বেশ সন্দেহের চোখে দু'হাতে কাপড় টেনে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে আসল। ঘর আলোকিত হয়ে গেল। দেখি সাদা কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে। লাশটা আসলেই নেই। পানির ট্যাপ থেকে পানি পড়া শুরু হলো।

আমি চুপ করে আড়চোখে বেসিনের দিকে তাকালাম।

 

ভাইয়া আপনি কী স্বপ্ন বলছেন নাকি সত্য?

সত্যি বলছি, বীথী। স্বপ্ন নয়।

তাহলে কিছু লুকোবেন না প্লিজ। যা দেখেছেন হুবহু বলবেন। লজ্জা করবেন না।

আমি আচ্ছা বলে আবার শুরু করলাম।

 

দেখি, একটা উলঙ্গ মহিলা একদম সরল ভঙ্গিতে তার গায়ের রক্ত ধুচ্ছে। একহাতে পানির ট্যাপ ছাড়ছে আর বন্ধ করছে। আরেক হাতে পানি নিয়ে শরীরে যেখানে রক্ত লেগে আছে সেখানে ধুয়ে নিচ্ছে। শরীরের কোন অংশে কাটা কাটির দাগ নেই। তবে রক্ত মাখানো। মুখটা দেখতে পেলাম না। বেসিনের আয়নায় মুখটা দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ঘুরে আছে। আমার অবস্থানের সাথে আয়নাতে সৃষ্ট তার মুখের বিম্বের সাথে আমার দৃষ্টি মিলছে না। মহিলাটির মাথাভর্তি কালো চুল। ঝুঁটি করে বাঁধল।

বীথী এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যে, মনে হচ্ছে আমি সত্যি সত্যি একটা লাশ থেকে অংগপাতি কেটেকুটে হাতে রক্ত মাখিয়ে তার সাথে নজরুল মিলনায়তনের বারান্দায় বসে অবলীলায় ভাত খাচ্ছি। ঠাণ্ডা মাথায় মার্ডার করে এসে ভৌতিক গল্প বলে চালিয়ে দিচ্ছি। এমন বানানো মিথ্যা একটা গল্প যে মেয়ে চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করে যাচ্ছে, তার রক্ত চোখ দেখে ইয়াকুব নাকি ভয়ে মরে। শালা কি বেটা ছেলে! বীথীর রক্তিম চোখে ইয়াকুব দেখবে তার জীবনের চরম অনুভূতি। সব চাওয়া পাওয়া।

আমি কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ি সেটাও বীথী জানে না। এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাও করেনি। আমি প্রাণিবিদ্যা বললাম, আর তাই বিশ্বাস করে বসে আছে।

আমাকে লজ্জা-শরম না করে সব কিছু বলতে বলেছে, বীথী। তাই আর কোন বাধা নেই। যা মুখে আসে তাই বলব। মাইন্ড করলে করুগগে। আমি আবার শুরু করলাম।

 

মহিলাটির পুরো শরীর উলঙ্গ। কিন্তু আমার সামনে তার একটুও লজ্জাবোধ হচ্ছে না। এতো সহজভাবে সে হাতে পানি নিয়ে গা ধুচ্ছে যেন মনে হচ্ছে পোশাকের ব্যাপারটা এরকমই। আমার গায়ে থাকলেও তার গায়ে থাকতে নেই। শীতে ঠাণ্ডা লাগার কথা, লাগছে না কেন, কে জানে? আমি আড়চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত বেশ মুগ্ধতার সাথে কয়েকবার মহিলাটিকে দেখলাম। মুখটা দেখার জন্য আয়নার মধ্যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তাকিয়েই আছি।

হঠাত ও দু'হাতে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বড় বড় চোখ করে আয়নার মধ্য দিয়ে আড়চোখে তাকালো আমার দিকে। মায়াবী চোখ। কাজল দেয়া। যেন ডগডগ করছে। মুখে রক্ত লেগে নেই। কিন্তু লাল টুকটুকে।

আমি চট করে চোখ সরিয়ে নিলাম। টেবিল পরিষ্কারে মন দিলাম। এমনভাবে টেবিল পরিষ্কার করছি যেন একটা লাশ কেটে তার হার্ট, লাং, লিভার মানুষ হাতে করে নিয়ে দৌড়ে চলে যাবে আর বডিটা উঠে বেসিনে ট্যাপের পানিতে গায়ের রক্ত ধুবে- ব্যাপারটা খুবই সিম্পল।

আমি মহিলার চেহারায় পরিচিত কাউকে খোঁজার চেষ্টা করলাম অনেক। পাইনি।

 

আপনি কি আপুটার প্রেমে পড়ে গেছিলেন ভাইয়া? বলল বীথী।

এমন কেন মনে হল তোমার?

না, এমনভাবে বলছিলেন- কিছু খুঁজছেন। মনে হচ্ছে আপুটা আপনার খুঁজে পাওয়া হারানো এক রাজকন্যা। ঠিক আছে- সরি, বলুন তারপর কী হলো?

 

ইয়াকুবের খাওয়া শেষ হয়েছে। কোন বাটিতে তরকারি নেই আর। পাতিলে ভাত নেই। গরুর মত খেয়ে উঠলো শালা। বলছে, চল। তোদের তো হাত শুকিয়ে গেছে। কী এত গল্প করছিস দু'জন? হাত ধুয়ে নে। বীথী, তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। আন্টি টেনশন করবে।

সে নিয়ে তোমার চিন্তা করা লাগবে না।

এতক্ষণ ভাইয়া কী গল্প করলো- শুনেছো কিছু?

না, খাওয়ার টাইমে আমার কোনদিকে মন থাকে না। বলল ইয়াকুব।

আমি বীথী কে এমন সুস্বাদু খাবারের জন্য ধন্যবাদ দিলাম।

ছি ছি ভাইয়া, কী যে বলেন। এসব ফরমালিটির দরকার নেই। আপনি তো খেলেনই না। সব তো ইয়াকুব খেল, একাই। আসলে আমি গল্প শুনতে গিয়ে আপনাকে খেতে দিলাম না। সরি। আপনার জন্যেই আরো বেশি করে খাবার এনেছিলাম।

শালা ইয়াকুব এজন্যেই সকালে খায়নি। জানতই যে বীথী বেশি বেশি খাবার আনবে। পরশুদিন বীথীর সাথে কথা হবার সময় নিশ্চয় ইয়াকুব পরে ভোল পালটে বলেছিল, আমি অনেক খাই।

আচ্ছা বলেন, তারপর কী হলো শুনি?

বাকি গল্প পরে হবে। আরেক দিন সুযোগ পেলে। তবে, আমি তখন এক পলকে আয়নার মধ্যে যা দেখেছিলাম তাতে বুক ফাটিয়ে শুধু এটুকু বলতে পারি, এত সুন্দর মানুষ আমি কোনদিন দেখিনি। কোথাও যে আর কোনদিন দেখব না সেটাও গ্যারান্টি।

চলবে...

No comments:

Post a Comment