Thursday, January 30, 2020

অতৃপ্তি

উৎসর্গ: তোমাকে
সত্যি বলছি!
পানপাতা চিবাও আর না চিবাও; তোমার রক্তিমতা গোধূলির লালিমাকেও চ্যালেঞ্জ করবে!
ইয়াকুব

পর্ব ১


এই সজীব, হাতমুখ ধুয়েছিস?
না রে, কয়টা বাজে?
সাড়ে সাতটা।
বাইরে কুয়াশা কেমন?
ঘন কুয়াশা। জানুয়ারি শেষ হলো আর শীতকাল মনে হচ্ছে নতুন করে আসছে। ঋতু বদলাচ্ছে। দেখিস এবার ফেব্রুয়ারিও শীতেই যাবে।
হ, কখন উঠলি ঘুম থেকে?
আজ সকাল সকাল জাগা পেয়েছি। একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলো। ফজরের নামায পড়ে একটু ঘুমুবো ভাবলাম, ঘুম আসলো না। চুপচাপ শুয়ে আছি।
স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গল মানে? দুঃস্বপ্ন নাকি? এই ঠাণ্ডায় গোসল করা লাগবে?
না, ওরকম কিছু না।
বলিস কী? সুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলে তো বিরাট ঠকেছিস। ঘুম না ভাঙ্গলে অনেকক্ষণ দেখতে পারতিস। ভালো লাগতো। দেখা যাচ্ছে তুই স্বপ্নে পড়ালেখা শেষ করে এসপি হয়ে গেছিস। এসি গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। বড়লোকের সুন্দরি মেয়ে বিয়ে করেছিস। আমি বেকার কোম্পানীর ম্যানেজার তোর বাসায় যাতায়াত করতে করতে তোর বউয়ের সাথে প্রেম শুরু করেছি। একদিন তোর বউয়ের সাথে শয়তানি করার সময় আমাকে হাতেনাতে ধরে হাজতে ঢুকিয়ে দারোগা দিয়ে পিটাচ্ছিস। তুই নানা রকম জরুরি কাজের ফাঁকে আমার দুর্দশা উঁকি মেরে দেখছিস আর মিটিমিটি হাসছিস। আমি দারোগার মার খেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে আছি আর তুই এসে আমাকে বলছিস, দেখলি আমার ক্ষমতা? বন্ধু ছিলাম বলে এখনো আমায় হাবাগোবা ভাবিস? মনে করেছিস আমার বউয়ের সাথে তুই টাংকি মারবি আর আমি হ্যাবলার মত চেয়ে চেয়ে দেখবো?
আমি ভীতু আর ফ্যালফেলে চোখে তোর দিকে তাকিয়ে থাকবো। আর তুই অট্টহাসি দিতে দিতে মন্ত্রী সাহেবের সাথে মিটিং করতে যাবি। তোর হাইফাই জীবন চলবে। সহজে ঘুম ভাংবে না। কারন ঘুম ভাংলেই দেখবি আমি তোর চাল নিয়ে রান্না করছি। দেখেও কিছু বলার সাহস পাচ্ছিস না। মনঃকষ্টের একটা পরিবেশ চলে আসবে। বাস্তবে তোর মত হাবার এসপি হবার সম্ভাবনা না থাকলেও স্বপ্নের জীবনটাকে দারুণ উপভোগ করতি।
আরে না রে দোস্ত, এরকম কিছু না। কোন সুস্বপ্নও না।
তাহলে?
আসলে বুঝতেছি না, সুস্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন?
বল দেখি শুনি, আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানি। অনেকগুলি সুলেমানি বই পড়েছি। যদি দেখিস কাক তোর মাথায় ঠুকরাচ্ছে তাহলে বুঝবি দুনিয়াতে তোর দুঃখ আছে। মাথার ব্যারাম হবে নয়তো দূর্ভিক্ষে মরবি। তোর মগজ শকুনে খাবে। সাপে তাড়া করলে বুঝবি পেছনে শত্রু লাগছে। বিবাহ দেখলে বুঝবি তোর গার্লফ্রেন্ড মরছে। যদি দেখিস ছাদ থেকে লাফাচ্ছিস, তাইলে বুঝবি পুরা জীবনই তোর ব্যর্থ। সফলতা পাবি না। যদি দেখিস শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাইলে বুঝবি তুই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবি। আর চোখ উল্টালে বিষ খাবি। কেউ হাত উঁচিয়ে ডাকলে বুঝবি মরণের চিঠি। ক্ষুধা লাগলে বুঝবি দুনিয়াতে তোর রিযিক শেষ। না খেয়ে বাঁচতে হবে বহু দিন। তৃষ্ণা লাগলে বুঝবি শেষ বয়সে সন্তানেরা তোকে যত্ন করবে না। পোড়া মাংস খেলে বুঝবি তোর হাগু খাওয়া রোগ হবে। ভায়াগ্রা দেখলে বুঝবি তোর বউ পরকীয়া......
থামতো।
আর শেষ রাতে যা দেখবি তাই সত্যি হবে। একদম হুবহু সত্যি হবে। বল শুনি, কী স্বপ্ন দেখলি ভোরে?
রাতে ফেসবুক চালাচ্ছিলাম। দেখলাম মামা তার বাচ্চার একটা ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছে। আর ক্যাপশন দিয়েছে, বাবু তিনদিন হলো তোমাকে দেখি না। খুব মিস করছি তোমায়। মামি তাতে কমেন্ট করেছে, তুমি কী পাষণ্ড পিতা! আমি হলে বুধবারেই ফিরে আসতাম। তিনদিন পরে ছেলের ছবি আপলোড করে ঢং দেখাচ্ছে। এরপর ঘুমালাম আর স্বপ্ন শুরু। স্বপ্নে আমি বারবার আম্মুর মলিন মুখ দেখলাম। আম্মুর এমন মলিন মুখ আমি কোনদিনই দেখিনি। আমি চোখ বন্ধ করে থাকছি তাও দেখতে পাচ্ছি। রাগে চোখে জোরে টিপ দিছি আর ঘুম ভাঙছে।
তোর আব্বু তো মারা গেছে?
হ, বছর কয়েক হলো।
সে জন্যেই তোর মাকে দেখেছিস। মরা মানুষ তোর দিকে মলিন মুখে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে- এরকম হলে তো চিল্লাপাল্লা করে আমারো ঘুম ভাঙ্গাতি।
ফাজলামি বাদ দে। তোর সুলেমানি জ্ঞানের কথা বল। দেখি কী শিখেছিস?
তোর বাড়ি থেকে আসা কয়দিন হলো?
এইতো, সাড়ে তিন মাসের মত।
এক কাজ কর। ক্যাম্পাসে তো অবরোধ চলছে। আজ ক্লাশ হবে না। নয়টার ট্রেনে বাড়ি যা। আবার সন্ধ্যায় ট্রেন ধরে চলে আসিস।
না, আজকে অবরোধে যাবো। আন্দোলন করবো। দাবি মেনে নিলে তবেই বাড়ি যাবো। একদিন ক্লাশ মিস হয় হোক।
তুই গরিব মানুষের ছেলে। ওইসব আন্দোলনে তোর যাবার কী দরকার? মারামারি হলে কী করবি? আন্দোলনের জন্য অনেক পোলাপান আছে। ওরা করবে।
আরে ধুর, ছেলেপেলে কারা আছে? সবাই গরীব। খুঁজে দেখিস ক্যাম্পাসে আমার থেকেও হাজারটা গরীবের ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে। কত ছেলে আছে যারা রিক্সা চালিয়ে পড়াশোনা করে। সেই দিনও এক ছেলে রাতে রিক্সা নিয়ে বের হইছে আর এক স্যার তাকে দেখে চিনতে পারছে। ছেলেটা লজ্জায় কাঁচুমাচু। আমিতো দুইটা টিউশনি করি। সবাই যদি ভয় করে বাড়ি চলে যায়, আন্দোলন করবে কে?
তাও এক কথা। ঠিক আছে থাক, দাবি আদায় করে ক্ষান্ত হ, বাড়ি যা।
দোস্ত, প্রতিদিন তুই রান্না করিস। আজকে আমি রান্না করি, তুই ঘুমা।
আচ্ছা কর, ভাত যেন পটপট না করে। ডাল সিদ্ধ করিস। আজ আলু ভর্তার বদলে ডাল ভর্তা খাই। রাতে ১০০গ্রাম ঘি এনেছি। ঘি দিয়ে মসুর ডাল ভর্তা করলে দারুণ লাগবে। টেবিলের কোণায় রেখেছি, দেখ। পলিথিনে মোড়ানো আছে। সাথে কয়েকটা শুকনো মরিচ ভাজিস। ঘিয়ের মধ্যেই ভাজিস।
ও খুব আগ্রহের সাথে আমার টেবিলের কোনা থেকে ঘিয়ের পলিথিন নিয়ে গেল। চাল ধুয়ে ভাত চড়িয়ে দিল। চুলার তারের আরেক মাথায় কোন প্লাগ নেই। দুই তারের মাথা সকেটের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিতে হয়। ও ছোটবেলায় এরকমভাবে ফ্যান চালাতে গিয়ে হাই ভোল্টেজের শক খেয়েছিল। সে ভয় এখনো কাটেনি। ভেজা হাতে সকেটে তার ঢুকানোর সাহস হচ্ছে না। আমতা আমতা করে বলল, দোস্ত, লাইনটা ওকে করে দে তো। হচ্ছে না কেন বুঝতেছি না।
আমি লেপের মধ্যে থেকে উঠে লাইন ওকে করে দিয়ে হাতমুখ ধুতে গেলাম। ফিরে এসে দেখি ও ঘি গলিয়ে একটা কৌটায় ঢেলেছে। এই কৌটায় করে ও বাড়ি থেকে আমের আচার এনেছিল। আচারের বেশিরভাগই আমি সাবাড় করেছি। চুরি করে খাওয়া লাগেনি। ও নিজেই আমাকে দিয়েছে। ওর নাকি আমের আচার খেতে ভালো লাগে না। ওর মা আচার বানিয়ে কৌটায় ভরে চুপ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আন্টির নাকি খিচুড়ির সাথে আমের আচার অমৃতের মত লাগে। আচারের আরো একটা বয়োম ট্রাংকে আছে। আশাকরি দুই এক দিনের মধ্যে ওইটা বের হবে।
আচ্ছা, তুই সুলেমানি বই পড়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা বাদে আর কিছু শিখিসনি? যাদু-বিদ্যা, মন্ত্র-টন্ত্র টাইপ কিছু?
হ, শিখেছি। শুনবি?
বল শুনি।
একটা ম্যাজিক শোন তাইলে। তোকে শিখিয়ে দেই। তোর এলাকার কোন এক দম্পতির নাম বল যাদের একজন মারা গেছে। কে মারা গেছে আর কে বেঁচে আছে আমি শুধু নাম শুনেই বলে দেব।
স্বামীর নাম- মোশাররফ আর স্ত্রীর নাম ফাতেমা।
স্ত্রী, তার মানে ফাতেমা মারা গেছে।
আরে হইছে তো!
হুম, আরেকটা বল।
তৈয়ব আর মরজিনা।
তৈয়ব।
বলিস কী! একদম সঠিক! কীভাবে পারলি, শিখাবি?
হুম। শোন তাহলে। নামের ‘অক্ষর’ আর ‘কার’ ও ‘ফলা’ নিয়ে খেলা। নামের প্রতি ‘অক্ষরের’ মান ধরবি ২, আর ‘কার’ বা ‘ফলার’ মান ধরবি ৩, তারপর যতগুলো অক্ষর আছে তাদের ২ দিয়ে গুণ করবি। ‘কার’ গুলোকে ৩ দিয়ে গুণ করবি। তারপর সবগুলো যোগ করবি। এভাবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামের হিসাব করে দুটো যোগফলের সমষ্টিকে ৩ দিয়ে ভাগ করবি। ভাগশেষ যদি ০ বা ১ হয় তাহলে ঐ দম্পতির স্ত্রী মারা গেছে। আর ২ হলে স্বামী মারা গেছে। ভাগফল কিন্তু নয়, ভাগশেষ। যেমন ধর, তোর বলা নাম,
মোশাররফ আর ফাতেমা
‘মোশাররফ’ এ মোট ‘অক্ষর’ আছে ৫ টি, তাহলে সূত্রমতে, ৫*২=১০, আর ‘কার’ আছে ২ টি, তাহলে- ২*৩=৬, এবার মোট যোগফল হবে, ১০+৬=১৬।
এবার ‘ফাতেমা’ তে ‘অক্ষর’ আছে ৩ টি, ৩*২=৬, আর ‘কার’ আছে ৩টি, ৩*৩=৯, যোগফল, ৯+৬=১৫।
এখন, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মানের সমষ্টি, ১৬+১৫=৩১, একে ৩ দিয়ে ভাগ করলে ভাগশেষ হয় ১, অর্থাৎ এই দম্পতিতে স্ত্রী মারা গেছে।
তৈয়ব আর মরজিনাতে, ‘তৈয়ব’ এর মান হবে, ৬+৩=৯, আর ‘মরজিনা’তে, ৮+৬=১৪, মোট হচ্ছে, ৯+১৪=২৩/৩, তাহলে ভাগশেষ হচ্ছে ২, এই দম্পতিতে স্বামী মারা গেছে। বুঝলি এবার ম্যাজিক?
ইয়াকুব কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর অবাক হয়ে বলল, আরে তাইতো! সব তো মিলে যাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব?
ও চুলার দিকে নজর না দিয়ে খাতা কলম নিয়ে বসে পড়ল। এক দম্পতির হিসাব করে মিলল না। ইয়াকুব হতাশ হয়ে গেল।
কী ব্যাপার? হিসাবে ভুল করলাম নাকি?
না, হিসাবে ভুল করিসনি। এই সূত্র ৮০-৯০% ক্ষেত্রে কাজ করে। অনেক দম্পতিতে কাজ নাও করতে পারে। ইয়াকুব খাতা কলম ফেলে চুলার কাছে এসে বসল।
আর কিছু জানিস?
হুম, একটা মন্ত্র জানি। স্বামী বশ করা মন্ত্র।
খুবই ইন্টারেস্টিং। স্ত্রী বশ করারটা জানলে আরো মজার হতো। আচ্ছা বল, এইটাই শুনি।
স্ত্রী বশ করার কোন মন্ত্র নাই। কোন তান্ত্রীক এই ঝামেলায় কোনদিন পড়ে নাই। যা ঝামেলা সব স্ত্রীদের, তাদের স্বামীদের নিয়ে।
অবাধ্য স্বামীকে বশ করার জন্য স্ত্রীকে তার মাসের প্রথম রক্তস্রাবের ব্যবহৃত ন্যাকড়া ভাত রান্না করার চুলায় আগুনে পুড়াতে হবে। তারপর ওই ছাই রান্না শেষে ভাতে মেশাতে হবে। সেখান থেকে প্লেটে করে এক চামচ ভাত নিয়ে কুকুরকে ‘আ তু’ বলে ডেকে খেতে দিতে হবে। অথবা লোকাল ভাষায় কুকুরকে ডেকে ওই খাবার দিতে হবে। তারপর কুকুরকে খেতে দেয়া ওই প্লেটের কিছু ভাত রেখে দিতে হবে। অর্থাৎ কুকুরের এটো করা ভাত রেখে দিতে হবে। আর স্বামী কাজ থেকে বাড়ি ফিরলে তাকে ওই প্লেটে হাঁড়ি থেকে ভাত নিয়ে কুকুরের এটো ভাতের সাথে মিশিয়ে ঠিক কুকুরকে যেমন আদর করে ডেকে খেতে দেয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই স্বামীকেও আদর করে ‘আ তু’ বা লোকাল ভাষায় ডেকে খেতে দিবে। ওই ভাত যদি স্বামী এক লোকমাও গিলে তো সারা জীবন বউয়ের আঁচল ধরে থাকবে।
ছি ছি। এটা কেমন ধরনের মন্ত্র? যদি না গিলে তো? বা স্বামী যদি বুঝে ফেলে?
তাহলে যা হবার তাই হবে। এই মন্ত্রের ক্ষেত্রে স্ত্রী’র হাই রিস্ক থাকে। তবে এটি কারেন্টের মত কাজ করে। গ্রাম বাংলার নারীরা তাদের স্বামীদের এভাবে যুগ যুগ ধরে...
চুপ কর। তোর এইসব বাজে মন্ত্র শেখার ইচ্ছা আমার একদম নাই।
ইয়াকুব চিন্তায় পড়ে গেছে। ওই নিজে এই খপ্পরে পড়ে কিনা তা ভাবছে মনে হয়। এই মন্ত্রের কথা মনে থাকলে শালা জীবনে বউকে জালাবে না।
ইয়াকুব মসুর ডালে ঘি ঢালতে ঢালতে বলল, সজীব, বলতো সর্বশেষ কবে ঘি মাখিয়ে মসুর ডালের ভর্তা খাইছিস?
মনে নেই। তবে মুসলমানি দিয়ে খাইছিলাম তা মনে আছে।
আমিও। আমার মুসলমানি দেয়ার পর ইয়ের ঘা শুকাতে দেরি হয়েছিল। তাই আম্মু মনে করেছিল ভর্তাতে ঘি কম হচ্ছে। তারপর ঘিয়ের পরিমান ক্রমেই বাড়ছিল আর টেস্টও বাড়ছিল। বারো দিন এভাবে খাইছিলাম। পরে যখন আর দিলো না তখন মনে হলো- ইশ, প্রতিদিন মুসলমানি হয় না কেন?
ঠিক আছে, তুই মেডিকেল থেকে আবার মুসলমানি দিয়ে আয়। কথা দিলাম ৭ দিন আমি তোকে নিজে হাতে ঘি দিয়ে ডাল ভর্তা করে খাওয়াবো।
ধুর, আমার আম্মুর মত ভর্তা তুই কোনদিনই করতে পারবি না। ফাইভ স্টার হোটেলের বাবুর্চির কাছে প্রশিক্ষণ নিলেও না। চল, একদিন আমার বাসায়। ভর্তার সেন্ট দিয়ে তোর চোখ বন্ধ করে দিব।
ওকে, আগে মুসলমানি দিয়া নেই। আমার ইয়ের ঘা শুকাতে দেরি হলে তোর বাড়ি গিয়ে ভর্তার সেন্ট নিয়া আসমুনে।
ইয়াকুব থেমে থেমে পরপর দুইটা হাই তুলল। একটা হাই তোলার পর সাথে সাথে আরেকটা হাই কেমনে আসে কে জানে। দুই নম্বর হাই এর ডিউরেশন একটু বেশি হলো। হাই শেষ না হতেই জিহবা জড়িয়ে ইয়াকুব কথা বলা শুরু করলো।
তুই কোন স্বপ্ন দেখিস না?
কেন দেখবো না? দেখি তো।
গল্প শোনা তো। কেমন স্বপ্ন দেখিস শুনি।
আমার স্বপ্ন সব ভৌতিক টাইপ হয়। তোর তো ভয় লাগবে।
আরে, আমি প্রতি শুক্রবার রাতে ভূত এফ এম শুনি। ভয় পাই, মজা লাগে।
ভূত এফ এম কী?
আরে, রেডিও ফূর্তির রাসেল ভাইয়ার একটা প্রোগ্রাম। অনেক মজার। ভূতের আজগুবি সব গল্প শোনায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষ। এরা কোন না কোন ভাবে ভৌতিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে।
তাই নাকি? রিয়েল কাহিনী নিয়ে?
হ।
বলিস কী! তার মানে সত্যি সত্যি ভূত বলে কিছু আছে নাকি?
কেন? তুই ভূতে বিশ্বাস করিস না?
করতাম না। ছোটবেলায় মা বই দেখে দেখে ভূতের গল্প পড়ে শোনাতো। ওইটা যে আসলেই আছে তা তো কোনদিন বলেনি। আমি জানতাম ভূতের গল্প আছে। ভূত আছে জানতাম না। কিন্তু কেউ দেখে থাকলে আর বিশ্বাস না করে উপায় কী? করলাম বিশ্বাস।
আচ্ছা তোকে বিশ্বাস করতে হবে না। এখন তোর একটা ভৌতিক স্বপ্নের কথা বল, শুনি।
স্বপ্ন নয়। তোকে আমি আমার জীবনে ঘটা একটা সত্য কাহিনী বলব। ভৌতিক নাকি জানি না। তবে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম এমনটায়।
আচ্ছা, এখন থাক। রাতে বলিস। ঘুমানোর আগে আলো বন্ধ করে শুনবো। ভয়ে শিউরে উঠবো। এখন শুনলে ভৌতিক কথাকেও হাসির মনে হবে। আর রাতের আন্ধারে গল্প বলার সময় টেবিল থেকে কলমের ক্যাপ পড়ে গেলেও পিলে চমকে যাবে। 

Monday, January 6, 2020

Saturday, January 4, 2020

ফুলপরী


অণিকার ক্লাসে মেঘ তৈরি পড়াচ্ছেন তার বিজ্ঞানের শিক্ষক আফজালুর রহমান। বৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার এক সুমহান উপহার। এটি বর্ষণ হয়ে মাটিকে জীবন দান করে। বর্ষিত এলাকা ভরে উঠে সবুজে। আধমরা গাছপালা নিজেদের ধুয়ে মুছে টকটকে সবুজ রঙয়ে ডাঙ্গর হয়ে উঠে। শুকনো মাটিতে পড়ে থাকা বীজগুলো অঙ্কুরিত হওয়ার উদ্দীপনা পায়। তরুণ সব গাছপালায় এলাকা ভরে উঠে। সবুজ পাতা, নতুন কুঁড়ি, ফুল, ফল আর তারপরে অপর্যাপ্ত নানা রকম শস্যে ভরে উঠে এলাকা। মৌমাছির ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রাণীকুল খাদ্য সন্ধানে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। শস্য থেকে আহার করে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে এসে কিছুটা আবার ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে। এভাবে জীবকুলে ভরে উঠে পুরো এলাকা। পুরো গ্রাম। পুরো দেশ। পুরো পৃথিবী।

অণিকা গালে হাত রেখে কনুইয়ে ভর করে বেঞ্চিতে ঠেস দিয়েছে। তার চোখদুটো এখন ফ্ল্যাটের বেলকনি ও তার আশেপাশের দৃশ্যপট দেখছে। স্যারের কথামত, বাসায় টবে লাগানো পাতাবাহারের গাছে কোন মৌমাছি আসে না। যাবতীয় প্রাণীকুল তাদের বাসার আরো সব রঙ্গিন পাতার গাছগুলো থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে না। তার জানামতে তাদের ফ্ল্যাটে বৃষ্টির পানির ছিটেফোটাও কোনদিন ঢুকেনি। টবগুলোতে তার আম্মু অনেক দিন পরপর মগে করে ট্যাপের পানি ঢেলে দেন। পাতাগুলো দিনরাত চকচকে। শুধুমাত্র অণিকাদের বিল্ডিঙয়ের গার্ড আকরাম কাকুর বিড়াল ছানা বাদে যাবতীয় জীবকুলের ক্ষেত্রে ‘আধমরা’ শব্দটি অণিকার কল্পনার বাইরে।

আফজালুর রহমান ক্লাসের পঞ্চাশ জোড়া উৎসুক চক্ষুকে উপেক্ষা করে মূলকথায় চলে আসলেন। তাহলে আজ আমরা জানব কীভাবে আকাশে মেঘ তৈরি হয়? আর তারপর বৃষ্টি ঝরে?

আফজাল সাহেবের গতিময় ব্যস্ত কণ্ঠকে মাঝপথে থামিয়ে ফ্ল্যাটের আজগুবি গাছগুলোর ব্যাপারে অণিকার স্যারকে জানানো হল না।

ভূ-পৃষ্ঠে আমরা অনেক রকম পানির উৎস দেখি। যেমন- পুকুর, নালা, খাল, বিল, ঝিল, নদী, সমুদ্র, পাহাড়ি ঝরণা আরো কত কী! এই আঁধারে অগণিত পানি অণু খুব শক্তভাবে পরস্পরের হাত ধরে থাকে। এসময় তারা সবাই মিলে তরলাবস্থায় বিরাজ করে। এটিকে আমরা পানি বলি। সূর্যের উত্তাপে পানির উপরিতলের অণুগুলোর মধ্যে হাত ধরা ধরির শক্তি কমতে থাকে। ধীরে ধীরে তাদের বন্ধন দূর্বল হয়ে পড়ে। একসময় লক্ষ কোটি পানি অণু একে অপরকে ছেড়ে পানি থেকে উড়ে বাতাসের সাথে মিশে যায়। এই ঘটনাকে পানির বাষ্পায়ন বলে। আর বাতাসের মধ্যে অদৃশ্য অবস্থায় যে পানি মিশে থাকে তাকে বাষ্প বলে। জলীয় বাষ্প। জলীয় বাষ্পের পানি অণুগুলো বাতাসের সাথে প্রবাহিত হতে থাকে। আর পানি উৎসের উপরিতল থেকে আরো উপরে উঠতে থাকে। এভাবে তারা পুকুর হতে রাস্তায় উঠে আসে। তোমাদের স্কুল ফিল্ডে এসে ভেসে বেড়ায়। বাড়িতে উঠে আসে। ফ্ল্যাটে উঠে। তারপর এক তলা দু তলা করে তিরিশ তলা বাড়ির ছাদে উঠে যায়। আরো উঁচু উঁচু সব বিল্ডিঙয়ের ছাদে উঠে যায়। তারপর তারা সবাই মিলে পাহাড় পর্বতের চূঁড়া লক্ষ করে। আর ভাসতে ভাসতে শেষে পাহাড়ের উপরে উঠে যায়। এরপর তারা আর টপকানোর কাউকে পায় না। বাতাসও আর তাদের নিয়ে উপরে উঠে না। তখন সব পানি অণুগুলো সেই নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে ভেসে বেড়াতে থাকে। ভেসে বেড়ানোর এক পর্যায়ে তারা লক্ষ করে যে, তাদের আশেপাশের খাল, বিল, পুকুর, নদী, সমুদ্র ইত্যাদি থেকে আরো অসংখ্য পানির অণুও তাদের মত সেখানে ছন্নছাড়া হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সবাই সবাইকে এভাবে একজায়গায় দেখে খুব অবাক হয়। তারা বেশ আনন্দের সাথে একে অন্যের হাত ধরতে থাকে। তাদের মধ্যে দুরুত্ত কমতে থাকে আর বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে। অল্প জায়গায় তারা সংখ্যায় অনেক হয়।

স্যার, আমাদের ক্লাস রুমে কি এক কোটি হবে? এরকম?

না, অণিকা। সে সময় বিলিয়ন বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সংখ্যায় থাকে তারা। আমরা গুণে শেষ করতে পারব না। এক কোটি অনেক কম।

এরা এই পর্যায়ে হাত ধরাধরি করে ভাসতে থাকে। আর সবাই মিলে বাতাসে ঘণীভূত হয়। এভাবে তারা সেখানের বাতাসকে সম্পৃক্ত করে। বাতাসের এই সম্পৃক্ততা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অসংখ্য পানি অণুর এই ভাসমান অবস্থা তখন আমরা আকাশে দেখতে পাই। এটি হল মেঘ। তুলনামূলক কম পানি অনু মিলে বাতাসকে ৫০ভাগ সম্পৃক্ত করে, তারা আরো বেশি সংখ্যায় মিলে ৬০ভাগ, তারপর ৭০ভাগ, ৮০, ৯০ এমনকি ৯৯ ভাগ পর্যন্ত সম্পৃক্ত অবস্থায়ও তারা একে অপরের হাত ধরাধরি করে উড়ে বেড়ায়। সম্পৃক্ততার এই পর্যায়ে তারা সংখ্যায়ও অনেক থাকে, তাই পরিমাণে বেশি হয় এবং অনেক ভারী হয়ে যায়।  বাতাসে এই অবস্থাতেও তারা ভেসে থাকতে পারে। পানি অণুগুলো বাতাসকে ৯৯ভাগ সম্পৃক্ত করার পর যে নতুন অণুগুলোর সাথে মিশে না তা নয়। তখনো তারা নতুন নতুন বন্ধু বানাতে থাকে। একে অপরের হাত ধরাধরি করে বাতাসের সম্পৃক্ততা আরো বাড়াতে থাকে। শেষে তারা বাতাসকে ১০০ভাগ সম্পৃক্ত করে ফেলে। এক পর্যায়ে পানি অণুগুলো বড় বড় কণায় পরিণত হয়। আর সবাই মিলে অনেক ভারী হয়ে যায়। একজোট হওয়া পানি অণুগুলোকে এই অবস্থায় বাতাস আর ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে না। পানির ফোটাগুলো তখন বাতাস থেকে অভিকর্ষের টানে ভূপৃষ্ঠের দিকে ঝড়ো গতিতে নামতে থাকে। লক্ষ কোটি পানির ফোটা সবাই যখন একসাথে নিচের দিকে ঝরতে থাকে তখন তারা সবাই মিলে নেচে নেচে গান গাইতে থাকে। তারা পাহাড়ের চূঁড়া হয়ে, তোমাদের ফ্ল্যাটের বিল্ডিঙয়ের ছাদ হয়ে তারপর তিরিশ তলা, ঊনতিরিশ তলা, আঠাশ তলা হয়ে পানির ফোটাগুলো নেচে গেয়ে মহানন্দে পরের তলায় ঝড়োবেগে নেমে আসতে থাকে। কোটি কোটি এই পানির ফোটাগুলোর অসংখ্য রকম গানের সুর যখন একসাথে আমাদের কানে আসে তখন আমরা ‘শঁ শঁ’ আওয়াজ শুনি।

শহরের নামকরা মডেল স্কুলের ক্লাস সেভেনের বিজ্ঞান ক্লাসে আফজাল সাহেবের বানানো এই পানির লক্ষ কোটি নাচুনে ফোটাগুলো অণিকাদের কল্পনার ঝাপসা চোখে এখন আকাশ থেকে নেমে ‘এলবি চৌধুরি ম্যানশন’ বিল্ডিংয়ের তিরিশ তলা হয়ে ঋতুদের ফ্ল্যাটের চৌদ্দ তলার উপরের পনের তলার মাঝামাঝি এসে হুট করে থেমে গেল।

আকাশে কালো মেঘ দেখে ঋতুর মামনি লুতফুন্নেছা খান অনেক আগে টের পেয়েছেন বৃষ্টি নামব নামব করছে। তিনি অফিস থেকে লান্সের পনের মিনিট আগেই বের হয়ে এসেছেন। ঋতু স্কুল শেষে বাসায় গেল কিনা সে ব্যাপারে লুতফুন্নেছার কোন মাথব্যাথা নেই। ড্রাইভার অন্যসব দিনের মত এতক্ষণে ঋতুকে বাসায় নিয়ে গেছে- তিনি তা ভাল করে জানেন। তাঁর চিন্তার মূল কারনটা হল- ঋতুর ঠাণ্ডা এলার্জি। বাচ্চা মেয়েটা একটু হাঁচি-কাশি শুরু করলে খান সাহেব সহ লুতফুন্নেছার হেনস্তার শেষ থাকে না।

খান সাহেবের মেয়ের যত্ন নিয়ে টেনশন নেই। মেয়ের দেখভাল তিনি তেমন করেন না। কাছে আসলে মামনি বলে চুমু দিয়ে দেন। মন ভাল না থাকলে “কলির সাথে খেলগা” বলে তাড়িয়ে দেন। ঋতুর যত্নের যাবতীয় তার মাকেই নিতে হয়।
আকাশে মেঘ চোখে পড়ার পর থেকে লুতফুন্নেছার মাথায় কয়েকটি শব্দ ভয়ার্ত রুপে ঘুরঘুর করছে। ঋতু, কলি, বৃষ্টি, বেলকনি, ঠাণ্ডা এলার্জি, হাঁচি-কাশি, অসতর্কতা, লুতফুন্নেছা, জনমের হয়রানি। তাঁর ব্রেইন শব্দগুলোকে আগপিছ করে ক্রমাগত আধোঃভৌতিক ধরনের নানা রকম সব জটিল বাক্য গঠন করে চলেছে। নতুন পানিতে ভিজলে সর্দি জর থেকে হাতির সাইজ মানুষেরও মুক্তি নাই, ঋতু তো ঋতু। এমন ধরণের একটা সরল বাক্য মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে ফুটপাথ হয়ে লুতফুন্নেছা দ্রুতপায়ে হেটে চলেছেন। আকাশে মেঘের ঘনঘটায় তাঁর উত্তেজনার শেষ নেই। লুতফুন্নেছার পায়ের তাগাদাকে বাংলায় অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়াবে, তাঁর বৃষ্টির আগে বাড়ি পৌঁছানো না হলে ঋতু পানিতে ভিজতে চৌদ্দ তলা থেকে কলিকে নিয়ে ফ্ল্যাটের বেলকনি হয়ে রাস্তার গলিতে লাফিয়ে পড়বে।

মেঘের তড়িঘড়ি দেখে, নিজের পায়ের দ্রুততায় আস্থা হারিয়ে ফেললেন লুতফুন্নেছা। পার্স থেকে মোবাইল বের করে খান সাহেবকে ফোন করলেন।

আলম তুমি কোথায়?

আলম সাহেব বেশ ভারি গলায় উত্তর করলেন, ফ্ল্যাটে।
বৃষ্টি নামছে, তুমি তাড়াতাড়ি ঋতুকে কলির থেকে সরিয়ে নিয়ে শাওয়ার দিয়ে দাও। কোনভাবেই যেন ও বৃষ্টিতে ভিজতে না পারে। ওকে বুঝতে দিও না বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। পরে কান্নাকাটি লাগাবে। আমি জ্যামে পড়েছি, আসতে দেরি হবে। প্লিজ আলম।

আলম সাহেব মেঘ বৃষ্টির সাথে ঋতুর মায়ের এমন উত্তেজনার কোন সঙ্গতি পেলেন না। অদ্ভুত কারণে তিনি কথাও বাড়ালেন না। টেলিফোন রেখে যান্ত্রিক ভঙ্গিতে বেলকনি থেকে ঋতুকে ধরে এনে কোন কথাবার্তা ছাড়াই সরাসরি শাওয়ারে বসালেন।

মামনি, আজকে হট শাওয়ার দেব?
জি আব্বু, কিন্তু সাবান মাখিয়ে দিও না। আমার চোখ জলে।

লুতফুন্নেছা আকাশের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন আর দ্রুতপায়ে হেটে চলেছেন। তাঁর পায়ের গতি মেঘের তড়িঘড়ির সাথে আরো দ্রুততর হচ্ছে। লুতফুন্নেছা ফ্ল্যাটের বিল্ডিঙয়ের গলিতে প্রায় ঢুকে গেছেন। এখন বিল্ডিং থেকে পঞ্চাশ গজের মত দুরুত্তে আছেন তিনি।

তাঁর ফ্ল্যাট সোজাসুজি ঠিক উপর থেকে নিচে একটা মেয়ে দুই হাতে আধমরা লম্বা ডালওয়ালা পাঁচটি করে গোলাপের কলি নিয়ে খালি পায়ে ফুটপাথের মাটিতে লুটিয়ে বসে আছে। সকাল থেকে সে মেইন রোডে জ্যামের সময় পাজেরোর সাহেবদের কাছে ঘুরে ঘুরে প্রায় চল্লিশটি গোলাপ সহ কিছু রজনীগন্ধার স্টিক বিক্রি করেছে। এখন বাঁকিগুলো নিয়ে গলিতে বড় বিল্ডিঙয়ের নিচে বসেছে। এসময় ম্যাডামদের বাবুরা স্কুল থেকে এসে ফুল কেনার জন্য কান্না করে। অল্প দামে দিলে ম্যাডামরা কথা না বাড়িয়ে বাচ্চাদের কান্না থামাতে চট করে দুই একটা করে কিনে নেন।

বিল্ডিঙয়ের নিচে মেয়েটার ফুল বিক্রি আজ প্রথম নয়। পুরো মহল্লায় তার ফুল বিক্রির সুখ্যাতি আছে। পাড়ার সবাই তাকে ফুলপরী ডাকে। মেয়েটির গায়ের বর্ণ কালো হলেও পাজেরোর সাহেবদেরও তাকে ফুলপরি ডাকতে দ্বিধা হয় না। সকালে যখন কোলে করে ফুলের ঝুড়ি নিয়ে মাথায় প্রজাপতি বসানো গোলাপি রঙয়ের ব্যান্ড পরে রাস্তায় বের হয়, ফুলঝুড়ি হাতে এই মেয়েকে তখন ‘পরী’ ছাড়া আর কিছু বলার মানানসই শব্দ আকস্মিক কারোর মাথায় আসে না।

ফুটপাথে লুটিয়ে বসে থাকা এই ফুলপরীর আনুমানিক বয়স বছর আষ্টেক হবে। হয়তো বয়ঃসন্ধিতে পা ফেলার ঠিক আগ মুহূর্তে সে।

লুতফুন্নেছাকে ফুল কেনার জন্য অনুরোধ করতে ফুলপরী ঘাড় উঁচু করল। একইসাথে মেঘের দিকে লুতফুন্নেছাও দৃষ্টিপাত করলেন। তাঁর মনে হল, ক্লান্ত চোখে তিনি বিল্ডিঙয়ের সাত তলার উপরে কিছু দেখতে পান নি।

লুতফুন্নেছার দৃষ্টি থেকে ফুলপরীরটা অনেকখানি উপরে গেল। সে দেখল দলে দলে বৃষ্টির ফোটা ঝাঁক বেঁধে ঝড়ো গতিতে তার দিকে নেমে আসছে।

আলম সাহেব ইতোমধ্যে গরম পানির ঝর্ণার সুইচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পানি শাওয়ারের পাইপের ভেতর ঘড়ঘড় শব্দে গতিশিল হয়েছে।

ঠিক এই মুহূর্তে অণিকাদের ক্লাসে আফজাল স্যারের বানানো বৃষ্টির ফোটাগুলো আবার চলতে শুরু করেছে। ঝড়োবেগে নিচে নামছে। ঋতুদের হট শাওয়ারের পানি পাইপের মাথায় পৌঁছার আগেই বৃষ্টির ফোটাগুলি তাদের চৌদ্দতলার ফ্ল্যাট অতিক্রম করে নিচে নেমে গেছে।

ফুলপরী এতক্ষণে রাস্তার মাঝখানে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফুল সহ তার দুই হাত ১৮০ ডিগ্রি কোণে দুইদিকে ছড়িয়ে ধরেছে। বৃষ্টি ফোটার দল এখন পঞ্চম তলায়। ফুলপরী দুইদিকে প্রসারিত হাত দুটো সোজাসুজি রেখেই আনুমানিক সত্তর সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধ্যের একটি বৃত্ত  তৈরি করে ঘুরতে থাকল।

মডেল স্কুলের ক্লাস সেভেনে তৈরি বৃষ্টি ফোটাগুলো আট বছর বয়সী ফুলপরীর উপরে ঝপাঝপ ঢেলে পড়ল। একইসাথে ফুলপরীর মাথার উপরে চৌদ্দতলার ঋতুকে ভিজিয়ে দিল হট শাওয়ারের ঝর্ণার পানি।

লুতফুন্নেছা পার্স ধরে কোন রকমে নতুন পানির ঝাপটা থেকে মাথা বাঁচালেন। দৌড়ে গিয়ে শেল্টারের নিচে দাঁড়ালেন। “আহ, বাঁচলাম” বলে এক সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

চৌদ্দতলায় ঋতু মনে মনে বৃষ্টি ভেজা একটা কদম ফুলের ছবি আঁকানোর জন্য পেন্সিল বক্স থেকে রঙ বাছাই করছে। আগামীকাল স্কুলে আর্ট ম্যাডামের হোমওয়ার্ক আছে। আলম সাহেব হট শাওয়ারের নিচে পানির কলের সুইচ আনমনে উল্টা প্যাঁচে ঘুরাতে চেষ্টারত মেয়েকে এক ভবিষ্যৎ লেডি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন। তবে লুতফুন্নেছা অবশ্যই ডাক্তার প্রিফার করেন। ঋতু পেটে থাকতেই তিনি ডাক্তারি বিদ্যার নানা বই বাজার থেকে কিনে এনে শব্দ করে পড়তেন।

ক্লাসে অণিকার মনে মেঘ বৃষ্টি গাছপালা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানে স্যারকে কিছু বলার সুযোগ হচ্ছে না। বাসায় গিয়ে সব প্রাইভেট টিচারকে এক এক করে জিজ্ঞাসা করবে।

ঋতুদের গলিতে বৃষ্টি থামেনি। ফুলপরী এখনো ঘুরেই যাচ্ছে। তাকে নিয়ে কারো আশা নেই। তারও কোন প্রশ্ন নেই। হাতের ফুলগুলো ভিজে চুপসে গেলেও কেউ মাথা উঁচু করেনি। তাদের সবাই জানে, বিক্রি হওয়া বন্ধু গুলোর কেউই সাহেবদের প্রেয়সির হাতে পৌঁছায়নি, পৌঁছায় না। ড্রাইভারের পাশের সিটে চিরকাল অযত্নে অবহেলায় মর্মর হয়ে পড়ে থাকে স্বপ্নহীণ তারা।

ছায়াহীন


    আমি আর কালু। দুইজন এসেছি। একটা গ্রাম বা শহর বা নগরী বলব কিনা বুঝছি না। কিছু একটা হবে। একটা এলাকা। পদ্মা নদীর একটা বাঁক চলে গেছে এদিক দিয়ে। নদীর উপর একটা ব্রীজ। ব্রীজের ওপারে গেলেই একটা নতুন নগরী। এই নগরীর মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এরা অন্য কোন এলাকায় যায় না। কাজ কাম বা রোজগার বা ব্যাবসার উদ্দেশ্যে। বরং এদের ভিন্নধর্মী জীবনচরিত দেখে বাইরের মানুষ আকৃষ্ট। এদের জীবনযাত্রা দেখে তারাই এদের এখানে আসেকারো কোন বড় কাজের দরকার হলে এদের দিয়ে করিয়ে নেয়। যেমন, কোন জেলের যদি পঞ্চাশটা জালের দরকার হয় তাহলে এখানে চলে আসবে আর এদের বলবে। এরা লোকবল জুগিয়ে অল্প খরচে সবচেয়ে ভাল করে জাল বুনে দেবে।

এই এলাকার লোকেরা এমন কোন কাজ নেই যে পারে না। নদীর ওপারে নাপিতের কাজ কামার পারে না। কৃষকের কাজ মুচি পারে না। মেথরের কাজ সাধারণ পাবলিকের কেউ পারে না। আর পারলেও করে না। অথচ এই এলাকার সবাই সব কাজ পারে। সবাই সব করে। একই লোক জাল বুনে দিবে আবার তার কাছে কেউ হারমোনিয়াম শিখতে আসলে শিখিয়ে দেবে।

আমি আর কালু পদ্মা পার হবার জন্য নৌকায় চড়লাম। পদ্মায় পানি নেই তেমন। নিচের বালি দেখা যাচ্ছে। নৌকার মাঝি নদীর এপারের মানুষওপারের কারো নৌকা নেই।

আমি আর কালু দুইজন এখন নদীর ওপারে। মানে সেই রহস্য নগরীতে। এখানের মানুষ গুলো আমাদের থেকে দেখতে আলাদা। চাইনিজ আর থাই এর মিশ্রণ মনে হচ্ছে। তবে কথা বলছে বাংলা ভাষায়। অনেক ভদ্র আর মার্জিত।

একটা বিশাল বাড়ি। বাড়ির ভেতরে অনেক বড় উঠান। পঁচিশ জনের মত লোক একসাথে কাজ করছে। বই বাঁধাইয়ের কাজ। কোন প্রকাশনী তাদের বই এনে এদের থেকে বাঁধাই করে নিয়ে যায়। এরা অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করে দেয়। লাভ বেশি হয়। আমি আর কালু তাদের কাজের মনোযোগ খেয়াল করলাম। তারা কেউ ই আগন্তুক আমাদের দিকে চোখ ফিরিয়েও তাকালো না। যার যার কাজ করছে মনোযোগ দিয়ে।

আমরা দুইজন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। বাইরে ঘুরাঘুরি করছি। অন্যদের দেখছি। এরা অনেক পরিশ্রমী। আর অনেক ভদ্রও বটে। আমাদের সাথে সবাই খুব ভালো আচরণ করছে । কিছু জিজ্ঞাসা করলে দারুণভাবে উত্তর দিচ্ছে। কোন বিরক্তি অনুভব করছে না।

সারাদিন ঘুরার পর বিকেল হয়ে গেল। আমি আর কালু নদী পার হয়ে চলে এসেছি। এপারে একটা রেল স্টেশন আছে। এই এলাকায় আসার জন্য এখানে স্টেশন বসানো হয়েছে। একটাই ট্রেন আসে সারাদিনে। একবার ভোরবেলায় আর আরেকবার সন্ধ্যা বেলায়। আমরা সন্ধ্যাবেলার ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যাব। সকালের ট্রেনে এসেছিলাম। এপারে এসে মনে পড়ল কী এক জরুরী জিনিস আমি ফেলে এসেছি। ওইপারের কোন এক দোকানে। ট্রেন মিস হলেও জিনিসটা আনতেই হবে। আজকের ট্রেন মিস হলে দরকার হয় ভোরের ট্রেনে যাব। তাও জিনিসটা ফেলে যাওয়া যাবে না।

আমি আর কালু আবার ফিরলাম সেই নগরীর উদ্দেশ্যে। নদীর সামনে এসে দেখি নদীতে ব্রিজ নেই। নৌকা নেই। নদীর পানি শুকিয়ে বালি বেরিয়ে গেছে। উপরে বাঁশের আড় দিয়ে এপার থেকে ওইপারে যাওয়ার রাস্তা করা। নিচে ওইপারের বাচ্চা পোলাপান খেলা করছে। আমি আর কালু শখ করে আড় বেয়ে নদী পার হলাম। শখের কারণে আড় বেয়ে পার হতে সময় লাগলো অনেক। নদীর ওইপারে গিয়ে সেই দোকানটায় আমার ফেলে আসা জিনিস টার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। লোকটি বলল, তারা কারো ফেলে রাখা জিনিষ নিজের কাছে রাখে না। তাদের একটা সংগঠন আছে। সারাদিন ঘুরে কারো ফেলে রাখা জিনিষ নিয়ে তাদের কাছে রাখে। পরে মালিক আসলে তাকে ফেরত দেয়া হয়। যত মুল্যবান জিনিস হোক না কেন, হারাবে না। ফেরত পাবেন। আমাকে আশস্ত করল এক দোকানদার।

আমি ঠিকানা নিয়ে পথ ধরে হাটা দিলাম। আমার সাথে কালু।

আমরা ঠিকানায় পৌঁছালাম। একটা বাড়ি। অনেক সুন্দর। ভেতরে গেলাম। বাড়ির ভেতর সবাই মেয়ে। কোন ছেলে নেই। কাপড় চোপড়ে এদের কোন শালীনতা নেই। আমরা দুইটা ছেলে ঢুকেছি তাতে তাদের ভ্রুক্ষেপও নেই। যার যার মত ঘুরছে। আমি একটা মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম আমাকে এই ঠিকানা দেয়া হয়েছে। এখানে আমার একটা ফেলে রাখা জিনিস আছে।

মেয়েটি আমাকে বলল, আপনার জিনিসটা এখানে আর নেই। অন্য যায়গায় চলে গেছে। মেয়েটি আমাকে আরেকটি বাড়ির ঠিকানা দিল। আমরা বের হয়ে একটা ভ্যান ভাড়া করে সেই বাড়িতে গেলাম। বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখি একটাই ঘর। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গল্প করছে আর হাসাহাসি করছে। আমি তাদের আমার হারানো জিনিসটার কথা বলার আগেই ছেলেটা কী যেন নিয়ে আমার সামনে আসল। আর বলল, এটা আপনার। আমি সেটা হাতে নিলাম। একটা কুকুরের বাচ্চা। সাদা ফটফটে। খুবই কিউট। আমার কী হারিয়েছে মনে নাই। কুকুরের বাচ্চাটা দেখে সেটা আর নিতেই ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে কিছু না বলে কুকুরটা নিয়ে চলে যাই। ডানে কালুর দিকে তাকিয়ে দেখি সে মেয়ে হয়ে গেছে। সালোয়ার কামিজ পরা। আমি খুবই আশ্চর্য হলাম। মেয়েটি আমাকে বলল, প্রবলেম নেই। এই বাড়ির মধ্যে যারা একবার ঢুকে তারা ছেলে মেয়ে হয়ে যায়। একজন এই বাড়িতে একা ঢুকতে পারে না। দুইজন ঢুকলে একজন ছেলে আর একজন মেয়ে হয়ে যায়। আপনারা ইচ্ছা করলে এখন এখানে সারাজীবন থেকে যেতে পারেন। কেউ কোনদিন বুড়ো হবেন না। আপনাদের বাইরের জগত নিয়ে কোন চিন্তাও করা লাগবে না। আমরা এখানে সাত বছর ধরে আছি। আর বেশ ভাল আছি। আপনাদের মত আমরাও এসেছিলাম এখানে। তারপর আর যাইনিএখানে আরো দুইজন ছিল। ওরা দশ বছরের মত ছিল। আমাদের আগে এসেছিল। পরশুদিন ওরা দুইজন চলে গেছে। অদের দুনিয়ায়। তাই বাবা আপনাদের পাঠিয়েছে এখানে। আপনারা যদি ইচ্ছা করেন তো থাকতে পারেন। না করলে চলে যান। ঘরের বাইরে গেলে এখানের সব স্মৃতি ভুলে যাবেন।

কালু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, থেকে যাই। আমি তো মেয়ে হয়েই গেছি। বাইরে গিয়েও যদি মেয়ে থাকি তখন?

আমি বাইরে গেলে আপনাদের বাবার সাথে দেখা করতে পারবো? এসবের কাহিনির নেপথ্যে জানতে পারবো?

আপনি বাইরে গেলে সব ভুলে যাবেন। তাই কোন সুযোগ নেই আপনার।

আমি পকেট থেকে নোটবুক বের করে বাবার ঠিকানা লিখে নিলাম। বাইরে গিয়ে কী কী করতে হবে মেয়েটার কাছে শুনে নিলাম। লিখে নিলাম। 

আমার হারানো জিনিসটা কুকুর নয়। ভুল হয়েছে আপনাদের।

বাইরে গেলেই ওটা আপনার হারানো জিনিসে পরিণত হবে। কুকুরটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখেন। এই বাড়িতে কোন মৃত বস্তু থাকে না। যা আছে সব জীবিত। বাইরে গেলে অইটা আসল বস্তু হয়ে যাবে যা আপনি হারিয়েছেন।

আমি আর কালু বাইরে চলে আসলাম। আমরা ভ্যান ভাড়া করে আবার নদীর পাশে এসেছি। পকেট থেকে ভাড়ার টাকা বের করতে গিয়ে নোটবুকের ছেঁড়া পাতা বের হলো। পাতা পড়ে বুঝলাম আমাদের কোথায় যেতে হবে। কোথা থেকে কীভাবে এসব লিখেছি তার কিছুই মনে করতে পারলাম না। ভ্যান ওয়ালাকে ঠিকানা বললাম, সে নিজেই আবার আমাদের আগের সেই মেয়েভরা বাড়িটার সামনে নামিয়ে দিল। ভেতরে গিয়ে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করার আগেই একটা মেয়ে আমাদের দুইজনকে ভেতরে নিয়ে গেল।

বাবা কোন ছেলে নয়। বয়স্ক কেউ নয়। একটা পিচ্চি মেয়ে। আমাদের দেখে বলল, আপনাদের আমি পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু আপনারা ভুল করলেন। আমি কাগজের লিখা পড়ে শুনালাম। তিনি বললেন সব ঠিক আছে। আপনারা এখন চলে যেতে পারলে চলে যান। আজ রাতে কোন তারা উঠবে না। যদি সকাল হওয়ার আগে ট্রেন ধরে চলে যেতে পারেন তো গেলেন। আর তারা উঠলে কাল পর্যন্ত সময় পাবেন। আর না হলে আপনারা দুইজন ই মেয়ে হয়ে যাবেন এবং এই বাড়িতে আপনাদের সারাজীবন থাকতে হবে। সবাই যেমন আছে এখানে। আপনাদের যেখানে পাঠিয়েছিলাম সেটা পছন্দ করলে ভাল করতেন।

আমি  আর কালু বিমর্ষ মুখে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগে। আমরা নদীর পাশে এসে দেখি নদী পানিতে ভর্তি। কোন নৌকা নেই। বাঁশের আড় নেই। ওপারে স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা নদীর এপারে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

আকাশের দিকে তাকালাম। সত্যি কোন তারা নেই। কালুর মুখচোখ শুকিয়ে গেছে। ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে। আমরা দুইজন বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। আজকের মত একটা তারা হলেও যেন উঠে।

রাত প্রায় শেষের পথে। তারাদের কেউ এখনো উঠেনি। আমি তাকিয়ে আছি নদীর কলকলে বয়ে চলা পানির স্রোতের দিকে। আর কালু আকাশের দিকে। সকাল হওয়ার আগে যেন একটা হলেও তারা উঠে।

কিছু মানুষের মনের আকাশের বিশালতা নেই। সে আকাশে কখনো উল্কা উড়ে না। চাঁদ-তারার অস্তিত্ব নেই। তাদের মাথার উপরে সামান্য অঞ্চল মিলে রয়েছে স্থির কালো মেঘ। যা কেবল কর্কশ শব্দে শুধু ভয় দেখাতে পারে। কখনো তা বৃষ্টি নামিয়ে স্নিগ্ধ সজীবতায় কাউকে ভেজাতে পারে না। ঘুটঘুটে এই মেঘের নিচে আঁশটে কুয়াশার সান্দ্রতায় এই ভীতুদের বাস।

মাথার উপরের আকাশে তারা নেই তাতে কী? কালুর মনের আকাশে ছায়াপথ আছে। সে হয়তো তার আকাশের তারাদের কখনো গুনে দেখেনি? জানেও না, তারা সংখ্যায় কত?

পত্র


[*লিটল বয়, আমেরিকান মুভি মুভিটির হিরো এক পিচ্চি বাচ্চা বাচ্চাটা তার যুদ্ধে যাওয়া বাবাকে ফিরে পাওয়ার আশায় এক অদৃশ্য বিশ্বাস নিয়ে বুক বেঁধে থাকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তার বাবার মৃত্যু সংবাদ আসার পরেও সে আশাহত হয় না বাবা ফিরে আসবে, আসবেই! বাচ্চাটার যুক্তিহীন বিশ্বাসের গভীরতা প্রিয় বাবার জন্য পথ পানে এই অবুঝ শিশুর অনর্থক অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকার কাহিনী যে কোন কঠিন হৃদয়কে কাঁদিয়ে ফেলবে
.*আয়েশা-লিও, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের বিখ্যাত উপন্যাস 'শী' এবং 'দি রিটার্ন অফ শী' এর কেন্দ্রীয় চরিত্র অপূর্ণ একটি প্রেমে তাদের দুই জনের জীবনের ত্যাগের মহিমা যে কারো হৃদয়কে হাতে ছুঁয়ে নেড়ে দিবে
]


আমি তখন বালক কিশোর হয়তো বয়সটা মনে নেই নারী জাতিকে আমি ছোটবেলা থেকে যে রকম দেখে এসেছি তাতে যেকোন মেয়ের প্রতি রাগ আর ঘৃণা ছাড়া কিছু জন্মেনি আমার জানি না, আমার জীবনটাতে নারীরা এভাবে আবির্ভূত হয়েছে কেন?

যখন বড় হতে শুরু করলাম, বুঝতে শিখলাম তখন দেখলাম আমার কাছে নারীদের এমন ঘৃণিত হবার পেছনে পুরূষ সমাজের বেশ দ্বায় আছে তবে পুরুষের যতটা না দ্বায় আছে তার থেকে নারীদের দ্বায়টা বেশি- তাদের এমন ঘৃণার পাত্র হওয়ার পেছনে

একজন ছেলে আর একজন মেয়ে একই পরিবেশে বড় হলেও তাদের দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকে আমি শারীরীক পার্থক্যের কথা বলছি না মানসিক পার্থক্যের কথা বলছি জানি না, আমার দেখা সেই নারী জাতী আসল নারী কিনা?

বই-পুস্তক, ইতিহাস-পাতিহাস যা কিছু পড়ি সব কিছুতেই মূল ধ্বংসের পেছনে কোন না কোন নারীর সূঁচের খোঁচা আছেই, থাকেই মোটকথা, আমি জীবনের একটা স্টেজে এসে নারীদের উপর এমন ধারণা পোষণ করি যে, যদি ছেলে মেয়ে একই মায়ের পেটে না জন্মাতো তবে তারা যে মানুষ- এটা থেকে আমার বিশ্বাস উঠে যেত

স্কুলে পড়ালেখার সুবাদে আমি পরিচিত হই অনেকগুলো মেয়ের সাথে যতগুলো মেয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি তাদের কাউকেই আমি আলাদা করতে পারিনি সবাই একই ক্যাটাগরীর নারী জাতিতে পড়ে স্কুলে আমি ৩৫ জন মেয়ের সাথে কাটিয়েছি- ক্লাস সিক্সে পুরো এক বছর এদের মধ্যে একটা মেয়েকে পেয়েছিলাম যে আমার পুরো ধারণা পালটে দিয়েছিল নারী সমাজের উপর থেকে তাকে দেখে, তার সাথে মিশে আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি- মেয়ে হয়ে পৃথিবীতে জন্মেছে তার সাথে মিশতে মিশতে এক সময় আমি তার উপর দূর্বল হয়ে পড়ি এটা আমার কিশোর বয়সের ঘটনা

আমি যখন কলেজে পড়ি তখনো তার উপর থেকে সে টানটা কমেনি ইচ্ছা ছিল যদি ভাগ্যে থাকে তো একে বিয়ে করে জীবনসঙ্গী বানাতে কোন সংকোচ করবো না, কোনদিন
আমাদের এমন কিছু স্মৃতি ছিল যে, কল্পনাও করতে পারিনি কখনো- আমরা দুজনে যদি হাজার আলোকবর্ষ দূরে থাকি তারপরও সে আমাকে ভুলে যাবে, ভুলতে পারবে এই স্মৃতি গুলির সবই তার বানানো আমার যতদূর মনে পড়ে- সে একদিন বলেছিল, স্বপ্নে দেখেছে এক বুড়ো মানুষের সাথে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অনেক কান্নাকাটি করছে আর তারপর সে বিয়ের আসর থেকে আমার কাছে পালিয়ে এসেছে আমাকে খুঁজে না পেয়ে হু হু করে কেঁদে উঠেছে এত জোরে কেঁদেছে যে, নিজের কান্নার শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে

জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এই মানুষটা আমাকে ভুলে গেছে ভুলে যেতে হয়েছে এই ভোলার পেছনে আমার কিছুটা দ্বায় আছে সে আমাকে মনে রেখেছিল, আমি জানি হলফ করে বলতে পারি প্রমাণও আছে আমার কাছে কিন্তু আমরা জানতাম, আমাদের জীবন কখনো এক হবার নয় আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম এটা সত্য আর সে জন্যে আমি তার কখনো খারাপ চাইতে পারিনি আমি হাত বাড়ালে হয়তো সে সমাজ-সংসার ত্যাগ করে চলে আসতো কিন্তু আমার জন্য তার দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবনটাতে আমার জীবনে দেখা একমাত্র মহীয়সীকে ছোট করতে চাইনি তাছাড়া আমার বাড়ানোর মত হাত তখন ছিলও না যদি বাড়ানোর মত হাত থাকতো তবে কোন প্রশ্ন ছাড়াই হাত বাড়িয়ে দিতাম তার দিকে

যাই হোক, সে এখন সুখী তার সুখ দেখে আমিও সুখী তাকে পাইনি ঠিক আছে সে এখন কেমন জানি না, তাও ঠিক আছে তার আর আমার জীবনের ইতিও ঘটে গেছে তার তৈরী করা স্মৃতিগুলো আমার মনে নেই রাখতেও চাই না আর শুধু একটা স্মৃতি মনে আছে ক্লাস এইটে আমার পেটে গ্যাস ফর্ম করেছিল টিফিনে না খেয়ে খেলে বেড়াতাম তাই সে জন্য কমপক্ষে এক সপ্তাহ টানা পেট ফাঁকা রাখা যাবে না মর্মে ডাক্তার আমাকে সাত দিনের খাবার রুটিন করে দিয়েছিলেন টিফিনে মা সবজি দিয়ে রুটি জড়িয়ে দিয়েছিল খাবার সময় আমি আর ওই মেয়েটা একসাথে ছিলাম আমি জড়ানো রুটি বের করে খাচ্ছিলাম তাকিয়ে ছিল আমার দিকে রুটি দুটো সবজি দিয়ে জড়িয়ে রাখার কারণে একটু কেমন হয়ে গিয়েছিল দেখতে তাকে আমি ভদ্রতা করে বললাম- আয়, দুজন মিলে খাই দুইটা আছে আমি একটার বেশি খেতে পারি না সে জড়ানো রুটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ওসব খাই না

ব্যাপারটা আমি ভুলে যেতে চেয়েছি স্মৃতিটা কেন যেন রয়ে গেছে মুছেনি বিলিভ মি, আমি এই ঘটনা দিয়ে তাকে কখনোই মনে রাখতে চাইনি

আমার জীবনে এর পর আর কোন মহীয়সী আসে নাই হাজারো রুপবান মেয়েকে দেখেছি কিন্তু কখনো কোন আকর্ষণ বোধ করিনি কারণ নারী জাতীর উপর তখনো আমার ঘৃণা কাটেনি এতটুকুও আমি জানতাম, যত রুপের নারী হোক না কেন, তার ভেতরে আমার সেই ঘৃণার বীজটা আছেই আর আমি তখনো বিশ্বাস করতাম যে- পৃথিবীর একটা নারীই সে, যে আমার জীবনে অল্প সময়ের জন্য এসেছিল চলেও গেছে আর কাউকে আমি তার মত কোনদিন খুঁজে পাবো না

তার সাথে আমার ইতি ঘটার বহুদিন পরে একটা মানুষ পুণরায় আমার জীবনে আসে সে কেমন জানি না কোন কারণ ছাড়া আমি তার উপর অদৃশ্য একটা টান অনুভব করি স্বর্গীয় টান দূর্বল হয়ে যাই তার উপর ধীরে ধীরে নয় এক দেখাতে প্রথম দেখাতে

আমার কী থেকে কী হয়েছে জানি না কোনদিন বলতেও পারবো না তাকে কেউ আমার সামনে ছোট করলে কেন জানি আমার সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে যায় তাকে যেন না দেখলে আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাই এই মেয়ের সামনে পড়লে আমি কেন জানি কথা বলতে পারি না একশ হাত দূর থেকে তার ছায়া দেখলেও মনে হয়, আমি থেমে আছি আর আসমান-জমিন আমাকে ছেড়ে ঝড়ো গতিতে দিক-বিদিক ছুটে চলেছে

আমার জীবনটা যদি একটা মালা হয় তবে সেই মালার সূঁতো সে যে আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসকে মালায় গাঁথা ফুলের মত করে ধরে রেখেছে আমি কেন জানি 'লিটল বয়' এর মত বিশ্বাস করতাম- এই মানুষটাকে স্রষ্টা যে কোন ভাবে আমার করে দেবে কীসের ভিত্তিতে বিশ্বাসটা করতাম, জানি না তার ব্যাপারে আমার এই বিশ্বাস যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে- তখন জানলাম তার বাগদান হয়ে গেছে আকাশ ভেঙ্গে প্রচণ্ড গতিতে আমার মাথার উপরে পড়তে গিয়ে থেমে গেল, পড়লো না পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে শুরু করলো এই মাটি ভাঙ্গেও না, সরেও না কাঁপতেই থাকলো আমি ভেঙ্গে পড়লাম ভেঙ্গে থাকলাম মনকে অনেক বোঝালাম যা আমার নয়, তাকে ভুলতে হবে মন থেকে তাকে কোনভাবেই মুছতে পারলাম না মন ডুকরাতে লাগলো গুমরাতে থাকলো একসময় আমি আকাশের দিকে তাকালাম তাকিয়েই থাকলাম- 'লিটল বয়' হয়ে

কয়েক বছর কাটল তাকে আকাশে খুঁজে বেড়াতে পেলাম না পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখলাম না সমাজ-সংসার সব কিছু আমার বিরুদ্ধে কেউ চায় না আমি তাকে- আকাশের শুন্যে খুঁজি যাকে চাই, সেও চায় না জানেও না যে, পাশে বসে থাকা মানুষটি তাকে মহাশুন্যে খুঁজে বেড়াচ্ছে

মেয়েদের একটা সিক্সথ সেন্স থাকে ন্যাচারাল তারা এই সেন্স ব্যবহার করে কিছু ¯পর্শকাতর বিষয়কে বুঝতে পারেআমার কাছে আশ্চর্য হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অলৌকিক নয়। মানুষটার সাথে আমি যতদিন কাটিয়েছি তাতে দেখেছি- আর দশটা সাধারণ মেয়ের মত সিক্সথ সেন্স সম্বলিত নয় সে বুঝতে পারে না- কোনটা চিটিং, কোনটা ফটকাবাজি, কোনটা বন্ধুত্ব আর কোনটা প্রেম স্বর্গীয় অনুভূতি

আমি এই মানুষটাকে এক সময় পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম জীবনকে নতুনভাবে সাজাতে লাগলাম পারলাম না আমি জানি, তাকে হারানোর এই ক্ষত কোনদিনই সারবার নয় এই ক্ষতে চিরকাল মাছিতে ডিম দিয়ে যাবে আর তা থেকে লার্ভা জন্মাবে তারা কিলবিল করবে

অবশেষে তাকে ছাড়া আমার জীবনকে নতুন একটা অধ্যায়ে পদার্পন করাই জীবনের যে জগতে আর কেউ থাকবে না কারো দরকারও নেই হবেও না নতুন এই জীবনে আমি তারপর আর কাউকে খুঁজতে চাইনি খুঁজতে যায়নি

জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর এই ধাপে গিয়ে আমি এবার একটা ভুল যায়গায় পা ফেলি আমার এই ভুল জায়গাটাকে চিনতে একটু সময় লাগে আমার বিশ্বাসের প্রতি আমি বিতৃষ্ণ হয়ে যাই মাথার উপরে ভেঙ্গে পড়ে থেমে থাকা আকাশটা আরো নিকটে চলে আসে পায়ের নিচের মাটির ¤পন আরো বাড়তে থাকে আমি যেন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীতে পরিণত হই সোজা হয়ে দাঁড়াতে ভুলে যাই

তাকে ছাড়া এভাবে অনেক দিন কাটে আমার আমি 'লিটল বয়' এর মত বিশ্বাস নিয়ে ঝাপসা চোখে মাথার উপরের ভেঙ্গে পড়া আকাশের দিকে শেষ আশা নিয়ে শেষবারের মত আরেকবার তাকাই দেখি আকাশটা মাথার উপরে নেই মাটি হঠাত তার ¤পন থামিয়ে দিয়েছে ক্ষতের পোকাগুলো কিলবিল করছে সে কীভাবে যেন আয়েশা হয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে! আমাকে লিও বলে ডাকছে আমার মেরুদন্ডরে হাড়গুলোর অস্তত্বি অনুভূত হয় বহুদিন পরে

আমার আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার অদৃশ্য বিশ্বাসটা 'লিটল বয়' এর বিশ্বাসের মত মিলবে কিনা- সেটা আয়েশা জানে আমার কাছে সে উত্তর নেই তবে এটুকু বিশ্বাস আছে, আমাকে আর মেরুদন্ডহীন হওয়া লাগবে না আয়েশা সেরকম নয়

ফিরে আসা আয়েশা মহীয়সী কিনা- জানি না জানার দরকারও নেই তারও মহীয়সী হবার দরকার নেই তার কস্ট, আমার কস্ট তার কান্না, আমার নদী তার সুখ, আমার সুখ তার চাওয়াটা আমার পাওয়া তার চোখ, আমার বিশ্বাস তার অনুভূতি- আমার ভালোলাগা

আয়েশা আমার জীবনের সূঁতো, যে মালার পুঁথির মত আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস কে গেঁথে রেখেছে তাকে জীবনের প্রথম যখন দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল- মেয়ে কোন মানুষ নয় মানুষের রূপ ধরে আমার সাথে পড়তে এসেছে নিশ্চয় পরী! আমার খোদার সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দরতমটি!