হাত-পা সটান হয়ে পড়ে আছেন ইয়াকুবের মা। বাঁশের বাতায় মাচা করে বানানো খাট। খুঁটিগুলো দুই ফিটের একটু বেশি উঁচু। সংখ্যায় মোট ছয়টা। মাচার উপর বিছানা। একটা শিমুল তুলার লেপ। তার উপর ছেঁড়া লুঙ্গি আর পুরনো শাড়ির কাপড় দিয়ে সেলাই করা কাঁথা। কাঁথার উপরে পুরনো চাদর। অল্পদিন হলো ধুয়ে দেয়া। জড়ো জড়ো হয়ে আছে। মাচায় বিছানো বাঁশের চাটাইয়ের উপরে লেপ থেকে চাদর পর্যন্ত একের পর এক স্তরীভূত হয়ে আছে। নিচ থেকে উপর পর্যন্ত এই স্তরগুলি ক্রমান্নয়ে ছোট। যে কারণে চাটাই থেকে শুরু করে লেপ-কাঁথা সহ চাদর পর্যন্ত সবগুলি পৃথকভাবে দেখা যাচ্ছে। ইয়াকুবের মায়ের মাথা বালিশে কিন্তু পায়ের কিছুটা চাদর আর কাঁথা ছেড়ে লেপের উপর উঠে গেছে। আমার সামনাসামনি আন্টির মাথার পেছনে উঁচু করে হারিকেন টাঙ্গানো। বেশি করে সলতে তুলে দেয়া হয়েছে। আমরা সবাই সবার মুখ দেখতে পাচ্ছি।
গ্রামে কারেন্ট আছে।
ইয়াকুবদের বাড়ি মাঠের ভেতরে হওয়ায় খুঁটি থেকে তার টেনে আনার মত দুরুত্তে তাদের বাড়ি
পড়েনি। নিয়মানুসারে তারা মিটার পায়নি। লোকজন ধরলে হয়তো একটা খাম্বা বসিয়ে দিত। ইয়াকুবের
বাবা বাড়িতে কারেন্টের এত প্রয়োজন মনে করেননি। এমনিতেই মইনুল কাকুর বাড়ি থেকে চোরাই
লাইন টেনে কারেন্ট চালাতে গিয়ে ইয়াকুব শক খাইছিল। তারপর বাড়ি থেকে কারেন্টের চিরবিদায়
ঘটেছে। যাবতীয় ইলেক্ট্রনিকস সরঞ্জামাদি সব বেচে দিয়েছেন ইয়াকুবের বাবা।
আমরা সবাই ইয়াকুবের
মা কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি। আমি দাঁড়িয়েছি ইয়াকুবের মায়ের পায়ের দিকটায়। মামি ইয়াকুবের
মায়ের ডানহাত ধরে বিছানার বামপাশে বসেছেন। ইয়াকুব ডানপাশে তার মায়ের মাথার কাছে বসেছে।
মাথায় হাত দিয়ে আছে। গামছা দিয়ে মাফলারের মত করে তার মায়ের মাথা পেঁচানো। এখন মোটামুটি
গরম পড়ে গেছে। গামছা দিয়ে মাথা বেঁধে দেয়া কেন, কে জানে? স্যার দাঁড়িয়ে আছেন
মামির বিপরীত দিকে। খাটের মাঝামাঝি পজিশনে। আমরা সবাই তাকিয়ে আছি ইয়াকুবের মায়ের দিকে।
আন্টির চক্ষু স্থির
হয়ে আছে টিনের চালে। ইয়াকুবের মায়ের স্থির চক্ষু বরাবর আমি উপরে তাকালাম। টিনে কয়েক
পট্টি করে লাল রঙয়ের টেপ মারা। টেপটা খুলে দিলে আংগুল সাইজ একটা ফুটোর আবির্ভাব হবে।
এই ফুটো দিয়ে বৃষ্টির দিনে পানি পড়বে। সকাল বেলা লম্বা ফোকাস করে ঘরে রোদ ঢুকবে। রোদের
ছটাটা পড়বে ঠিক আন্টির চিত হয়ে পড়ে থাকা ডান হাতের তালুর উপরে। তারপর সূর্যের পূর্ব
থেকে পশ্চিমের গতিময়তায় ছটাটার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটবে। ধীরে ধীরে সূর্যের তেজ কমতে
থাকবে। ছটাটা মিলিয়ে যাবে। সন্ধ্যা নামবে। বিছানায় শুয়ে এই ফুটো দিয়ে উল্কা দেখা যাবে।
তারা গোনা যাবে। পূর্ণিমার চাঁদ দেখা এমনকি তার আলো এসে ঘর ভরে দিতেও কোন কার্পণ্য
করবে না। আন্টি হয়তো টিনের ফুটো দিয়ে তারা দেখার চিন্তা কোনদিন করেননি। পাশের বিশাল
বাবল গাছে ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ানো জোনাকি পোকারা দল বেঁধে ঘরে ঢুকে যাবে, বৃষ্টির পানি পড়ে বিছানা ভিজে যাবে- সে জ্বালায়
ইয়াকুবকে দিয়ে বাজার থেকে টেপ কিনে এনে ফুটো বন্ধ করিয়েছেন।
বৃষ্টির পানি গড়ালে
এই টেপের আঠা এক সেকেন্ডের মধ্যে নাই হয়ে যাবে- সেটা ইয়াকুব জানে। মায়ের ইচ্ছায় হয়তো
টেপ লাগানোর সময় সে জোর করে কিছু বলেনি। মা বলেছে টেপ লাগাতে, ও সরল মনে লাগিয়েছে। কয়েকস্তর করে লাগিয়েছে।
গত ২ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে
মারামারি হওয়ার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। কবে খুলবে আর
খোঁজ খবর নাই। বাড়ি এসে খাচ্ছি-ঘুমাচ্ছি,
বন্ধুদের
সাথে আড্ডা দিচ্ছি।
বাড়িতে আমার চাপ
কম। কখন ফিরি, কখন ঘুমাই, কখন খাই- খোঁজ খবর রাখার কেউ নাই। শুধু মা বলে-
খাওয়ার অনিয়ম করিস না বেটা। যেখানেই থাকিস,
খাওয়ার
টাইমে এসে খেয়ে যাস। খাওয়ার টাইমে আসতে আধা ঘন্টা-এক ঘন্টা কমবেশি হলে কোন প্রবলেম
হয় না। গতকাল দুপুরে বাড়িতে খেতে বসেছি। মা বলল, তোর নানি আসতে চাইল তোকে দেখতে। তুই আসলে মোবাইল করতে বলেছিল।
কবে থেকে এসে বসে আছিস, আমার তো মনেই নাই।
থাম, মোবাইলটা আনি। কল দে, আমি বলে দি, আসতে। মা মোবাইল আনতে গেল আমার ঘরে। মোবাইল এনে আমার হাতে দিল, আমি নানির নাম্বার বের করছি এসময় ইয়াকুবের ফোন।
কিরে? কী অবস্থা? ক্যাম্পাস খোলার কোন খবর পেলি নাকি?
সজীব, শোন,
আমার
আম্মুর একটু সমস্যা হয়েছে। আমি বাড়ি আসার পরে হঠাত সেদিন আম্মু মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে
যায়। মাথায় পানি ঢেলে, এটা সেটা করে জ্ঞান
ফেরে না। লোকজন ধরে বাজারে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। কী যে হলো জানি না। কয়দিন বিছানায়
ভালোই ছিল। কথাবার্তাও বলল অল্প অল্প। ভাবলাম আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন পর
কথা বার্তা বলা কমা শুরু করল। আম্মু বলল,
হাতে
পায়ে শক্তি পাচ্ছে না। এবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলাম। নানা ঔষধ পত্র
দিয়ে ডাক্তাররা ভালো খাটাখাটনি করল। কিছুতেই কিছু হলো না। অবশেষে মেডিকেল থেকে প্যারালাইজড
বলে ফিরিয়ে দিল। মামি কাল এসেছেন আম্মুকে দেখতে। একরামুল স্যার আগামীকাল আসবেন। তুইও
চলে আয় আজ। তোর কথা আম্মুর কাছে গল্প করেছিলাম। তোকে দেখতে চেয়েছে। বলছে কখন মরে যাই, ছেলেটাকে আসতে বল। তুই বিকেলে বাস ধরে চলে আয়।
তিনটার বাসে উঠতে পারলে রাত ৯.৩০ এর মধ্যে পৌঁছে যাবি। না করিস না দোস্ত।
আচ্ছা দেখছি- বলে
আমি ফোন কেটে দিলাম।
ইয়াকুবের ঘটনা আমার
মা কে বললাম। মা আমার সাথে আসতে চাইলো। আমি আনিনি। বললাম, থাক। তুমি পরে যেও। ওদের বাসার অবস্থা না জেনে
একসাথে দুইজন যাওয়া ঠিক হবে না। আসার সময় মা আমাকে আব্বার থেকে ১০০০ টাকা এক্সট্রা
নিয়ে দিল। বলল যে, যাওয়ার সময় কিছু
কিনে নিয়ে যাস। তোর বাপ এসব পছন্দ করছে না। এই এক হাজার বের করলাম মেলা কষ্টে। তোর
বাপেরও ধার-দেনা হইছে অনেক। বেশি চাপ দিলাম না।
চলবে...
No comments:
Post a Comment