Friday, May 14, 2021

আবছায়া

             চাচা, দুধ কত করে লিটার?

পঁয়তাল্লিশ টেকা কেজি বাপ। দামাদামি না করলে চল্লিশ দিও।

তিরিশ টাকা হবে? দেড় লিটার নিতাম।

না ব্যাটা। এত কমে দিবার পারুম না। দ্যাড় কেজি ষাট ট্যাকা হয়। তুমি পাঁচ ট্যাকা কম দিও।

আচ্ছা দুই লিটার দেন, ষাট নিয়েন। ত্রিশ টাকা লিটার দরে।

না বাপ। সত্তর ট্যাকা দিও।

আচ্ছা দেন।

চাচা প্লাস্টিকের বোতলে ফানলে করে দুধ ঢালছেন। দুধ তোলার পাত্রটা বেশি বড় না। অনুমান করে পাত্রটা তিনি নিজেই বানিয়েছেন। দুই পাত্র দুধে চাচার হিসেবে আধা সের হয়। গ্রামের ছোটখাট বাজারে দুধ বিক্রি করেন তিনি।

বাড়িতে ছোট ছেলে-মেয়ে থাকলে শুধু তাদের জন্য বাজার থেকে অল্প পরিমানে গরুর দুধ কিনে খদ্দেররা। বাড়ির বড়দের জন্য দুধ কিনে খাওয়াকে শ্রেফ শখ মনে করে চাচার এলাকার মানুষ। গ্রামের বাজারে দুধ বিক্রি করলে একজন ক্রেতার জন্য চাচাকে ড্রাম থেকে সর্বোচ্চ দুই পাত্র পরিমাণ দুধ তুলতে হয়। এই দুই পাত্র দুধের পরিমাণ চাচার হিসেবে হাফ কেজি। বেশিরভাগ মানুষ একপাত্র পরিমাণ দুধ কিনে। তাই চাচা দুধ বিক্রি করা পাত্রের সাইজ- এর থেকে বড় করার কথা তার সাত বছরের গোয়ালা জীবনে চিন্তা করেননি।

চাচার বয়স মোটামুটি সত্তরের উপরে হবে। উপরের আর নিচের মাড়ি মিলে সামনের দুইটা করে চারটা দাঁত পড়ে গেছে। কথাবার্তায় তোতলামি চলে এসেছে। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী নাতনী লিলির মত শব্দ উচ্চারণে চাচার তেমন অদক্ষতা নেই। তাঁর দাবী, এই দাঁত গুলো ঊনসত্তরের শেষে পড়েছে। সত্তরে এসে তিনি তোতলামি ধরেছেন। নাতনির মত কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন। এতে তিনি অখুশি নন। বরং নাতনির সুরে কথা বলতে পেরে চাচা বেজায় খুশি।

চাচার ছেলে-মেয়ে তিনটা। বড় ছেলের বয়স গত দুই বছর আগে সাতচল্লিশ পার হয়েছে। হার্ট এটাকে মারা গেছে। ছোট ছেলেটা অল্প বয়সে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। পঁয়ত্রিশের মত বয়স হবে। বিয়ে হয়েছিল সাতাশ বছরে। তখন সুস্থ ছিল। সুঠাম দেহী। হঠাৎ ডায়বেটিসে ছেলেটার শরীর খেয়েছে। শুকিয়ে কঙ্কালসার অবস্থা। বাড়িতে বসে বসে মরার জন্য দিন গুণছে। বউয়ের বয়স কম হওয়ায় মেয়ের বাবা-মা ছাড়িয়ে নিয়েছে। অন্য জায়গায় বিয়েও দিয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ের সময় বউটার বয়স ছিল তেইশ বছর।

এদিকে বড় ছেলের বউয়ের বাচ্চা হচ্চিল না। অনেক চেষ্টার পর জাদুমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, ডাক্তার-কবিরাজ সহ যাবতীয় চেষ্টায় সাঁইত্রিশ বছর বয়সে একটা কন্যা সন্তান হয়েছিল। সেই লাইলি এখন পাঁচ বছরে। লাইলিকে নিয়ে বড় বউ এখনো শ্বশুরের সংসারে ঘানি টেনে চলেছে। ছোট ছেলেকে দেখাশোনা করে। শ্বশুরের সেবাযত্ন করে। লাইলির মায়ের ধারনা তার জীবন শেষের দিকে। তাই এখন শেষ জীবনে নতুন ভাবে জীবন শুরু করার তেমন আগ্রহ আর পরকিল্পনা কোনটইি তার নেই। মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি বাকি জীবন কাটানোর ইচ্ছা তার।

বাপের অভাবের সংসারে চাচার মেয়েটা আসে খুব কম। বছরে দুই একবার। চাচাই মাঝেমধ্যে নাতি-নাতনিদের দেখতে যান। জামাই বাবাজি বেশ অমায়িক আচরণ করেন চাচার সাথে। মেয়ের বাড়িতে একদিনের কাছে আরেকদিন বেশি থেকে আসলে জামাইয়ের মুখে মলিনতার ছাপ চাচা কোনদিন দেখেননি।

চাচীকে হারিয়েছেন গত পাঁচ বছর হলো। রাতে ঘুমিয়ে ছিল দুইজনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চাচীর কপালে চুমু দিয়ে চাচা বুঝতে পারেন বুড়িটা আর নেই। শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঘুম থেকে উঠে শুধু সেদিন ই কি চাচীর কপালে চুমু দিয়েছিলেন?

বিয়ার পর থাইকা ঘুম ভাইঙ্গে ওরে কবে চুমু খাই নাই, মনে নাই। চাচা মুচকি হেসে তোতলালেন।

কান্নাকাটি কেমন করেছিল জিজ্ঞাসা করা হয়নি। মানুষের সবকিছু জানতে নেই। কিছু জিনিষ একান্ত ব্যক্তিগত। কিছু আবেগ অনুভূতি দুর্বোধ্য। সেগুলো অকারণে ছুঁতে চাওয়া দুঃসাহস।

       চাচা বেশ আনন্দিত ভঙ্গিতে বোতলে দুধ ঢালছেন। টিনের ফানেল দিয়ে কলকল শব্দে দুধে পূর্ণ হচ্ছে বোতল। দুই লিটার দুধ একসাথে বিক্রির অভিজ্ঞতা হয়তো তাঁর গোয়ালা জীবনে এটাই প্রথম। চাচার চোখ-মুখের কুঁচকানো ভঙ্গিতে তা স্পষ্ট। 

আড়াইশ মিলি পরিমানের পাত্র দিয়ে দুই লিটার দুধ তুলতে হলে মোট আটবার তা দুধের ড্রামে ডুবাতে হবে। পাত্রটা এইবার দিয়ে ছয়বার ডুবানো হলো। সাতবারের বেলায় বোতল ভরে গেল।

একটু ধরে দিয়েন, বোতলের মুখ পর্যন্ত ভরে দিয়েন- এসব বলা লাগলো না। চাচা বললেন, তুমার তো জায়গা কম। আরেকটা বোতল আনো বাবা। দুই সের তো হয়নি। আরাক কাপ দেয়া লাগবি।

       আর লাগবে না চাচা। হয়েছে। আপনে সত্তর টাকাই রাখেন। এই নেন।

       চাচা মিয়া এক পোয়া দুধ জায়গার অভাবে দিতে পারলেন না জন্য দশ টাকা ফেরত দিলেন।

       দুধ এত পাতলা কেন- চাচা মিয়া?

       একাক দিন একাক রকম দুদ হয় বাপ। যিদিন অল্প হয় সিদিন একটু ঘুনো হয়। আইজ দুদ একটু বেশি হইচে।

       শহরের বাজারে দুধের দাম বেশি পাওয়া যায়। পাতলা দুধ হলেও ক্রেতারা তেমন আপত্তি করে না। সবাই জানেই পানি ছাড়া দুধ পাওয়া যায় না। দুধে পানি দেয় না এমন লোক দুনিয়াতে আছে- সে বিশ্বাস শহরের লোকদের উঠে গেছে। বাজারের দুধের ঘনত্ব নিয়ে তারা তেমন কোন আপত্তি দেখায় না। কিনল, খেল- মিটে গেল। দুধের তরলতার জন্য গোয়ালাদের গায়ে পড়ে কেউ দোষী করতে আসে না।

শহরের বাজারে দুধ বিক্রি করে গোয়ালাদের এই একটা সুবিধা আছে। দুধে কমবেশি পানি মেশানো যায়। দামও ভাল পাওয়া যায়। চাচার গ্রামের বদরুল গোয়ালা এই কাজ করে। গ্রামের বাজারে মানুষ বাকি দুধ নেয়। টাকা পয়সা দেবার খবর নাই। আবার একটু পাতলা হলে নানান অভিযোগ। বদরুল তাই শহুরে বাজার ধরেছে বছর দুই হলো। দুই তিন গ্রাম ঘুরে সে পনেরো লিটারের বেশি দুধ পায় না। শহরের বাজারে তার দুধের বিক্রি পঁচিশ লিটারের উপরে। যাতায়াত ভাড়াসহ যাবতীয় খরচ মিলে পাঁচ লিটারের দাম যায়। বাকি বিশ লিটারের টাকা পকেটে থাকে। বদরুলের এমন নগদ টাকা দেখে চাচাও শহরমুখি হয়েছেন। চাচার গ্রাম থেকে শহরের এই বাজার ত্রিশ কিলোর মত হবে। এই বাজারে চাচা চ্যাংড়া কালে হেঁটে এসেছেন। নানার সাথে বাজার করে ডালা মাথায় নিয়ে আবার হেঁটে বাড়ি চলে গেছেন।

আজকে এসেছেন কিলো দশেক রাস্তা দুধের ড্রাম ঘাড়ে আর তারপর ভ্যানগাড়িতে চড়ে বাজার পর্যন্ত। দুধ বিক্রি হলে টাকা হবে। নাতনির জন্য চুড়ি কিনে হাট-বাজার করে পুরো রাস্তাই এবার ভ্যানগাড়িতে যাবেন।

আমাকে ফেরত দেওয়া দশ টাকা চাচাকে দিতে যাচ্চিলাম এমন সময় এক লোক বোতলে করে দুধ নিয়ে চাচার কাছে আসলো।

বলল- চাচা দুধে পানি দিছো কয় সের? কলের দিছো না পুকুরের?

লোকটির উচ্চ-বাচ্চে মুহুর্তে লোকজন জড়ো হয়ে গেল। মানুষজন জড়ো হওয়া দেখে চাচা মশাই হতভম্ব হয়ে গেলেন।

পানিতো মিশাই নাই বাপু, কী কথা কও! কোনরকমে একবার কথাটা মুখে সরলো চাচার।

লোকটি বোতলে করে আনা দুধ থেকে উপস্থিত জনতাকে একটা জীবন্ত শামুক বের করে দেখালো। বলল, কি চাচা মিয়া? এটাতো গরুর বাঁট থেকে পয়দা হইছে, না?

শামুকের খোঁজে একজন দুধের ড্রামে হাত চালিয়ে দিল। ড্রামের তলা পর্যন্ত হাত দিতে তার ভাঁজ করা শার্টের হাতা দুধে ভিজে গেল। হাত ঘুরিয়ে ড্রামের তলা থেকে সেও একটা শামুকের বাচ্চা বের করে আনলো।

উগ্র জনতা চাচার ড্রামে হামলা করলো। দুধ ভর্তি ড্রাম রাস্তায় উলটে দিল। আরো ছয়-সাত লিটার দুধ হয়তো ড্রামে ছিল। দুধ উল্টে দেয়ার পর রাস্তায় আরো কয়টা জ্যান্ত শামুকের বাচ্চা উদয় হলো।

চাচার চোখমুখ কুঁচকে আছে। গঁ গঁ টাইপ শব্দ বের হচ্ছে গলা দিয়ে।

জনতা এখনো থেমে নেই। যথারীতী স্যান্ডেলের চড় থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে কয়টা।

কয়জন এসে লাত্থিও মারলো লোকটাকে। অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু হয়ে গেল। দুধ বিষয়ক ঘটনায় চাচার বুড়িটাকে নিয়ে অকথ্য রসাত্মক কিছু কথা না বলেই ছাড়লো না উগ্র জনতার কয়জন। এসময় চাচা মুখ থুবড়ে পড়ে ছিলেন। তাঁর মুখভঙ্গি অদৃশ্য।

কিল-ঘুষি-লাত্থি বেদম আকারে শুরু হয়ে গেল। দুধের ড্রামটা মূহুর্তের মধ্যে মুখ থোবড়ানো চাকতিতে রুপ নিল।

মার খেয়ে বেচারা মাটিতে লুটিয়ে আছেন। দুইজন গিয়ে টেনে তুলল। একটু শান্তি করে মারবে তাই।

চাচার পিঠ কুঁজো । বয়সের ভারে নাকি দশ কিলো রাস্তা পানি মেশানো দুধের ড্রাম বয়ে এনে- বোঝার উপায় নেই। লোকটার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। গোঁফের আড়ালে স্যাঁতসেঁতে দেখাচ্ছে।

আমি হট্টগোল থেকে বের হয়ে এলাম। চাচার পক্ষ নিয়ে কিছু বলার মত কোন পরিস্থিতি এখন নেই।

চলে আসার সময় চাচার মুখে সর্বশেষ শুনলাম, তিনি তোতলাতে তোতলাতে কাঁদো স্বরে বলছেন- আমাকে মাইরো না বাপ ধনেরা।

দাদু নিশ্চয় লিলির মত করে তোতলিয়ে শহরের বাজার থেকে তাকে এক গোছা রঙ্গিন চুড়ি কিনে দিবে বলেছিলেন। লিলি আজ সন্ধ্যায় তার দাদুর জন্য অপেক্ষা করবে। সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার ধীরে ধীরে কালোতে পরিণত হবে। লিলির অপেক্ষমাণ চোখ দুটো একসময় ঘুমে ঢলে পড়বে।