Friday, September 25, 2020

ঘোলাটে

দুজন দুদিক থেকে বগলের নিচ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ঘাড়ে সেঁটে উঁচু করে ধরে রেখেছে। মুখ দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে লালা ঝরছে। যেন এক মুঠো লাল রঙয়ের ছাঁচি মরিচ এইমাত্র গাছ থেকে তুলে কচমচ করে চিবিয়েছি। মুখের ভেতর আগুনের গোলা তৈরি হয়েছে। জিহ্বা সহ উপরের তালু ও মুখের ভেতরে দুই গালের মাংসে দাউ দাউ করে জ্বলছে। দুই ঠোঁট মিলে এই আগুন গাল, চোয়াল, থুঁতনি কোন কিছুতে লাগতে বাদ নেই। আমি যতটা সম্ভব দুই চোয়াল কোনরকম টেনে হা করে বাতাস নেয়ার চেষ্টা করছি। হা হওয়া মুখ দিয়ে ক্রমাগত ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে আর গরম বাতাস বের হচ্ছে। বাতাস ঢোকার সময় একটু আরাম পাচ্ছি, বেরুনোর সময় আগুন ফুলকি দিয়ে উঠছে। এখন ঝালের সাথে হালকা নোনতা স্বাদ পাচ্ছি। 

আমি দুই চোখের পাতা টেনে চোখ খুলতে চেষ্টা করলাম। চোখ পুরোপুরি না খুললেও আলো দেখার মত অবস্থা হল। আর অন্য সবকিছু ঘোলাটে। আমি স্থির হওয়ার চেষ্টা করলাম। ধীরে ধীরে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করল। গত বছর নানিকে যখন চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম, ডাক্তার সাহেব নানীর চোখের সামনে পাওয়ারের কাঁচ ধরে বললেন, কেমন দেখছেন নানী? নানি বলল, ঘুলা। ডাক্তার আরেকটা কাঁচ নিয়ে ধরলেন। নানি আবারো বলল, ঘুলা। আরেকটা কাঁচ ধরলেন। নানী বলল, সামান্য পরিষ্কার। ডাক্তার সাহেব কাঁচের বাক্স বদল করলেন। এই বাক্সের তিনটা কাঁচ পরিবর্তনের পর নানি বললেন, ফুলবানু জন্মের পর যকুন চোখ ঘুলা হইয়ে গেচিল, কিছু আন্দাজ করতে পারচিলাম না। সামনের কেডা কুনডা চিনতে পারচিলাম না। তকুন ফুলবানুক গামচায় জড়ায়ে সামনে আনার পর আমার চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হইলো আর তারপর দুনিয়ার সব ঝকঝকা হয়া ফুলবানুকে যেমুন লাল টুকটুকি দেকিচুনু ঠিক সিরকম দেকতে পাচ্চি। নানির মত আমার চোখও ঘোলাটে থেকে ধিরে ধিরে ঝাপসা হলো। তবে এখনো ফুলবানু খালাকে দেখার মত অতটা পরিষ্কার হয়নি।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবার হাতে কাঁচা বাঁশের একটা করে লম্বা লাঠি। চোর পিটানোর জন্য সব বাড়িতে বাঁশের লাঠি থাকে। বছরে কয়েকবার চুরি হলেও দুই একবার সেই চোর ধরা পড়বে কিনা তার যে কোন গ্যারান্টি নেই- সেটা লাঠিওয়ালা জানে। তাদের ধারণা এই লাঠি মাথার কাছে নিয়ে ঘুমালে চোর ঘরে ঢোকার সাহস পায় না। লাঠিগুলো মাথার কাছে নিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে তাদের বছরের পর বছর কেটে যায়। কটকটে পাকা বাঁশের হলেও বয়সের ভারে লাঠিগুলোতে ঘুণ ধরে যায়। বাড়ির গিন্নির খড়ির সমস্যা হলে সেই ঘুণে ধরা লাঠি এনে চুলায় ঠেলে দেয়। ঠিক এদিন রাতে অলৌকিকভাবে চোরের পায়ের শব্দে বাড়িওয়ালার ঘুম ভাঙ্গে। মাথার কাছে হাত দিয়ে লাঠি না পেয়ে চিল্লাতে থাকে। লাঠি কই, লাঠি কই? 

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কারো হাতে এমন ঘুণে ধরা পাকা বাঁশের পুরণো লাঠি দেখছি না। গ্রামের সব গিন্নি হয়তো একদিনেই তাদের লাঠিগুলো চুলায় ঠেলেছে। 

এই লাঠিরগুলোর বাঁশ আজ সকালেই ঝাড় থেকে কেটে আনা মনে হচ্ছে। গিরা থেকে বের হওয়া কঞ্চিগুলো বাঁশের গা ঘেঁষে তাড়াতাড়ি করে এবড়ো থেবড়ো ভাবে এক কোপে কাটা। কাটা কঞ্চিগুলো ছোট ছোট চোখে হা করে তাকিয়ে আছে। একটা লাঠির একপ্রান্ত ফাটিয়ে আলগুলোর মাঝখানে ছোট ছোট পিস পিস কঞ্চি গুঁজে দেয়া হয়েছে। আলগুলো চোঁখা করে বর্ষার ফলার মত আকৃতি দেয়া। হাত চালাতে একটু কমবেশি করলেই চোঁখা আলগুলো ফট করে কারো চোখেমুখে ঢুকে যাবে- এমন খচখচে ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। এ অস্ত্র দিয়ে সবশেষে আমার বুক বরাবর আঘাত করা হবে।

সকালের ঠাণ্ডাটা এখন বগলের নিচের অংশে অনুভব করছি। কিটকিটে। ঠ্যাং দুটো আছে দেখতে পেলাম। আমার দেহের সাথে তাদের সংযুক্তি এখনো অনুভব করিনি। ঘাড় সোজা করে তাকাতে পারছি না। শিরদাঁড়ায় হাড্ডিগুলোর অবস্থান আপাতত অনুভূতিহীন। উরুতে আঁকাবাঁকা অসংখ্য কালশিটে। হাঁটুর উপরে থেঁতলানো। বাম হাঁটুতে চকচকে সাদা হাড্ডি বের হয়ে আছে। ডান হাঁটুর থেঁতলানো চামড়ায় রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে। তলপেটের নিচের লোমশ অংশ উন্মুক্ত।


এইতো শুয়োর তাকাইচে- বলে একজন বগলের নিচ থেকে মাথা বের করে নিল।

তৎক্ষণাৎ ঘাড়ের নিচে একটা ঝটকা অনুভব করলাম। চিৎকার করলাম কিন্তু শব্দ হলো না। সাথে সাথে অপর পাশ থেকে আরেকটা আঘাত। কাঁচা বাঁশের লাঠি ঝড়ো গতিতে ঘাড়ের নিচটায় এসে আছড়ে পড়ল। আঘাতটা তেমন অনুভব করলাম না। তবে এক কোপে কাঁটা একটি কঞ্চি ঘাড়ের মাংসে পিচ করে ঢুকে বেরিয়ে গেল- বুঝতে পারলাম। আমি উপুড় হয়ে থেঁতিয়ে পড়লাম। চোখ আবার ঘোলাটে হয়ে গেল। নগ্ন গায়ে এলোপাতাড়ি আঘাতের ফট ফট শব্দ পাচ্ছি। গিরার কঞ্চিগুলো প্রতিটা বাড়ির সাথে শরীরের পশ্চাতদেশের মাংসে দ্রুত মুখ ঢুকিয়ে আবার বের করে নিচ্ছে।

মুখ হা হয়ে আছে। লালা ঝরা থামেনি। হাঁপানো কুকুরের মত লালা ঝরছে। নিঃশ্বাসের জন্য এখন মুখটাই ভরসা। নাক ভর্তি সর্দি ঝেড়ে ফেলার শক্তি পাচ্ছি না। জোরে জোরে কয়েকটা দম ফেলার পর মুখের সামনের ধুলাগুলো উড়তে শুরু করলো। খানিকটা আবার লালার সাথে মিশে মুখের সামনে কাদাকাদা হয়ে জমে গেল। দুজন এসে আবারো আমাকে আগের ভঙ্গিতে বগলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে উঁচু করে ধরলো। 

রাতে যখন গরু নিয়ে বের হলাম। বাড়ির কেউ জাগা পেয়েছে বলে মনে হলো না। মাঠে এসে দেখি সাতজনের বেশি। জাল দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। গরুর দড়ি ছেড়ে জান নিয়ে দৌড়ানি দিলাম। আমি আর গরু দুজনেই জালে আটকে গেলাম। সবাই মিলে গরুটাকে বের করল। আমি পেঁচিয়ে গেলাম। তারপর কেউ একজনকে বলতে শুনলাম, মার শালাকে। এলোপাতাড়ি মার শুরু হল। উপর থেকে ডান কাঁধে একটা বাড়ি পড়ল, আরেকটা মাথায়। তারপর চোখ খুলে দেখি কুয়াশায় ভর্তি আকাশের নিচে চিৎ হয়ে পড়ে আছি

কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমার হাঁটুতে কাঁটা ফুটাচ্ছে। একজন পায়ের তালুতে বসেছে। আরেকজন বুকের বামপাশে। তিনজন মিলে দুই হাতের আঙুল ধরে আছে। একজনের ভাগে পাঁচটা। সে একহাত পুরোটা নিয়ে বসেছে। আর বাকি দুইজনের ভাগে তিনটা আর দুইটা করে। এরা দুইজন আপন ভাই। ছোটবড়। বড় ভাই ধমক দিয়ে ছোটটার চেয়ে একটা আঙুল ভাগে বেশি নিয়েছে। কাঁটা ফুটাচ্ছে। আমাকে তাকাতে দেখে সবাই নানু নানু বলে দৌড় দিল। আমি তাদের নানুকে দেখার জন্য ঘাড় বাঁকানোর চেষ্টা করলাম। দুজন লোক এসে আমার পেটের উপর পাড়া দিয়ে গেল।

আবার দুজন এসে টেনে তুলে বসিয়ে দিল। সাথে সাথেই ঝড়ের বেগে আলাদাভাবে দুই লাঠির দুই বাড়ি একসাথে এসে আমার উপর আছড়ে পড়ল। একটা পিঠে আরেকটা মাজায়। বাড়ি দুইটা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করলে মণ দুইয়েক হতো। আমি আবার চিৎপটাং হব এমন সময় আরেকটা বাড়ি পড়ল মাথার উপরে। তারপর আবছায়া ভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

এই সময়টার মাঝে বাটিতে করে মরিচ বেঁটে এনে আমার মুখে পুরে দেয়া হয়েছে। দুই পাটির দাঁত নাকি শক্ত হয়ে আটকে ছিল। তাই মুখ খুলতে সুপুরি কাটা জাঁতি দিয়ে বেশ কসরত করা লেগেছে। আগুন গরম ঝালের মধ্যে নোনতা স্বাদের এই একটা ব্যাপার হতে পারে

আমার বামপাশে কাঁটা ফুটানো পিচ্চিগুলো এখন বেশ ভীতু চোখে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এই ভীতু চোখের কারণ আমি নই। ওদের দিকে যে আমার তাকানোর সাধ্য নেই, বুঝে গেছে। ওদের দৃষ্টি এখন আমার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশেষ বাচ্চার দিকে।

একজন লোক সেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল- ব্যাটা, তুমি পতিশোদ নিবে না? তুমার হাম্বার দড়িত এই শুয়োর হাত  দিচে।

লোকটার এই ব্যাটা বেঁটে গড়ণের। গোলগাল চেহারা। টুসটুসে গাল। ছোট ছোট চোখদুটো গালের মাংসের ঠেলায় ভিতরে ঢুকে গেছে। কপালের ডানপাশে সকালে ওর মা কাজলের কালি দিয়ে টিপ দিয়ে দিয়েছে। শীতের কারণে টিপের কালি আঠার মত লেগে আছে। ছেলেটির কোমরে গামছা জড়িয়ে নেংটির মত পরা। খালি গা। ড়ো বাছুরের মত থলথলে মাংসে ভর্তিবাচ্চাটার হাতদুটো গামছার ন্যাকড়ায় জড়ানো। ন্যাকড়ার মধ্যে দুই হাতের চার আঙুলের মাঝখানের তিন ফাঁকে লম্বা লম্বা তিনটি করে ছয়টি খেজুরের কাঁটা গাঁথা। হাতদুটি শক্ত করে মুঠো করা। কাঁটাগুলি এতটাই তরতরে যে, দেখে মনে হচ্ছে- চোরের গায়ে ফুটানোর জন্য সেগুলো বিশেষভাবে বাছাই করা হয়েছে। চোর ঘুমিয়ে আছে, ঘুম থেকে উঠলে তাকে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে- এমনটা বলে এতক্ষণ বাচ্চাটাকে থামিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিশোধের জন্য সে সকাল থেকে কাঁটা সংগ্রহ ও ফুটানোর প্র্যাকটিস করছে। কাঁটা ফুটানোর আগ্রহে যে তার একটুও ঘাটতি নেই তা হলফ করে বলা যাবে। এমন শীতেও ঘেমে আছে।

ছেলেটার চোখ আমার তলপেট বরাবর। নায়ক জসিমের মত দুহাত মুঠো করে ঘুষি মারার চেষ্টা করলে প্রতিটা ঘুষি ওর উচ্চতা অনুযায়ী আমার লজ্জাথান বরাবর পড়বে।

একবার ভাবলাম হাত দিয়ে লজ্জাস্থানটা ঢাকি। চোখ ঘুরিয়ে হাতের দিকে তাকালাম। হাত দুটো কব্জি থেকে মুচড়ে উলটো দিকে ঘুরে আছে। আঙুল নড়ানোর চেষ্টা করলাম। নড়ল না। কব্জির হাড় থেকে দুটো হাতই বিচ্ছিন্ন।

বাচ্চাটা আমার দিকে সোজাসুজি মুখ করে তাকিয়ে আছে। দুই হাত আরো শক্ত করে মুঠো করার চেষ্টা করছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। নিঃশ্বাসের সাথে তার বুক পেটের পেশী ক্রমাগত উঠানামা করছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। গায়ের থলথলে মাংস এখন এঁটেসেঁটে আছে। কাঁটাগুলো দিয়ে আমাকে আঘাত করতে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসার জন্য সে তার পায়ের পেশীতে শক্তি সঞ্চয় করছে। আঙ্গুলগুলো ধুলোর মধ্যে ঢেউয়ের তালে টিপটিপ করছে। প্রতিশোধের প্রজ্জলিত আগুন তার চোখেমুখে।

ছেলেটার মা নিশ্চয় প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তার বাচ্চাকে বই হাতে তাড়া করে বেড়ায়। আজ হয়তো তিনি আমার জন্য আরেক দফায় মরিচ বাটতে ব্যাস্ত

বাচ্চাটি তার বাম পা সামনের দিকে এগিয়ে নিল। পেছন থেকে আচমকা আমার মাথা ছুঁয়ে ঘাড় বরাবর লম্বালম্বি ভাবে আরেকটি বাড়ি পড়ল। চোখ দুটো আবারো ঘোলাটে হয়ে গেল।

অন্তরে আমি

বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি। খুলনা যাবো। এক পরিচিত আপুর বিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে আপুর সাথে সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। কিছুদিন রুমমেটও ছিলাম। বিয়ের দাওয়াতটা এমন যে, যেতেই হবে। দুনিয়াতে যদি কেয়ামতের আল্টিমেটাম হয়, সূর্য যথারীতী সকালে পশ্চিমে উঠে পূর্বে ভেসে যাচ্ছে এরকমও হয়- তবুও আজকের ডেটে আমাকে যেতে হবে। দাবীটা আপুর নয়। আন্টির। আমার উপর কী কারণে আন্টির এমন দাবী, অনুমেয় নয়।


আমার হাতে একটা ছোটখাটো ট্রাভেল ব্যাগ। আগামীকাল বিয়ে। শনিবারে ফিরবো। বেশি কিছু নেয়ার প্রয়োজন নেই। বিয়ে বাড়িতে সাজুগুজু করার জন্য একটা মেকাপ বক্স আর পরার জন্য একটা শাড়ী নিয়েছি। সাথে দুই সেট সালোয়ার কামিজ। হাফ লিটারের সেভেন আপের বোতলে এক বোতল পানি আর এক হালি কলা। কেনা পানি আমি খেতে পারি না। ফিল্টার পানি তেতো লাগে। বমি ভাব আসে। পেট ঘেটে উঠে। ৭-৮ ঘন্টার রাস্তায় শুধু হাফ লিটার পানি আর চারটে কলাতে সামাল দিতে পারবো না। বাস থেকে নেমে আরো কতদুর যেতে হবে কে জানে?


পাউরুটি কেনার জন্য রাস্তার অপর পাশের এক খুপরি দোকানে গেলাম। ভালো মানের পাউরুটি নেই। দুইটা ছোট ছোট রুটি আছে তাও গতকাল এক্সপায়ার ডেট শেষ হয়ে গেছে। দেখতে খারাপ লাগছে না। এক্সপায়ার ডেট দেখিনি এমন ভঙ্গি করে খেয়ে নিলে সমস্যা হবেনা। এই বাস স্টপে আর কোন দোকান খোলা নেই। কেন খোলা নেই কে জানে। রেল স্টেশন-বাস স্টপ এসবের আশেপাশের দোকানগুলো ২৪/৭ সার্ভিস দেয়। অথচ এখন সব গুলোই বন্ধ। শুধু আকবর হোটেল খোলা। ভাতের হোটেল। ভ্রাম্যমাণ মানুষগুলি এই হোটেলে চড়া দামে ভাত খায়।


মাথার উপরে কটকটে রোদ। পিচঢালা রাস্তায় রাজ্যের গরম। বড় বড় ট্রাভেল ব্যাগ হাতে বাসের অপেক্ষায় অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাইফাই জামাকাপড় পরা। সাহেব বাবু চেহারা বেশিরভাগের। ভাতের হোটেলের ভেতর থেকে চড়া দামে ভাত খেয়ে বের হচ্ছে অগণীত মানুষ। ঘুরে বেড়াচ্ছে টিকেট কালোবাজারি করা সব টাউট বাটপার। বড় বড় বাস এখানে এসে ব্রেক কষছে। জানালা দিয়ে বাচ্চারা, মহিলারা বাসের পেট্রোলের গন্ধে বমি করছে। মাথার উপরের সূর্য তার ইচ্ছামত রাস্তায় তাপ ঢেলে চলেছে। রাস্তাও সমান তালে সে তাপের বিকিরণ করছে। বাসগুলি ভদ্রলোকদের কিছু নামিয়ে দিচ্ছে, কিছু তুলে নিয়ে হুশ করে টান দিয়ে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা ক্লিয়ার করছে।


-আফা, দুইডা টেকা দেন। গরীব মানুষ।


সাত থেকে দশ বছরের বাচ্চা হবে। গোলগাল চেহারা। গলার স্বরে ভারত্ব আসা শুরু করেছে। আমার দিকে হাত টান করে এগিয়ে ধরে আছে। পা দুটো হাটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা। দু’হাত মুঠো করে তাতে ভর দিয়ে ছেঁচড়িয়ে ছেঁচড়িয়ে আসলো। দু’হাতের কনুই থেঁতলে আছে। চোখমুখে ধুলা জমে ঘামে ভিজে কাদাকাদা অবস্থা।

আমি পার্স থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে দিলাম।


-আফা নেন।

-কী নিব?

-টেকা ফেরত নেন। আমি তো দুই টেকা চাইলাম। আফনে পাঁচ টেকা দিলেন, তাইলে তিন টেকা ফেরত পাবেন।


একটু পর এই স্টপে আমি থাকবো না। দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকদের কেউ থাকবে না। থাকবে শুধু টাউট-বাটপার, রাস্তায় ছিটিয়ে পড়া কাঁচা বমি। আর উত্তপ্ত রাস্তার উপর ছেঁচড়িয়ে চলা অবহেলিত এই মানুষগুলো। সাথে তাদের হাতে গুঁজে দেয়া আমাদের বিরক্ত মুখের ভালোবাসা। গতিময় এই ভদ্র সমাজে প্রাপ্য তিন টাকা ফেরত নিতে, এখন দশ বছর বয়সী এক ভিক্ষুকের কাছে আমাকে হাত পাতা লাগবে। আমি এদিক ওদিক খেয়াল করলাম, কেউ আমাকে দেখছে না। শুধু আমরা একে অপরকে দেখছি।


আমি চিন্তিত চোখে আর ছেলেটা হিসেবে ভুল করেছে এমন ভঙ্গিতে!

Thursday, January 30, 2020

অতৃপ্তি

উৎসর্গ: তোমাকে
সত্যি বলছি!
পানপাতা চিবাও আর না চিবাও; তোমার রক্তিমতা গোধূলির লালিমাকেও চ্যালেঞ্জ করবে!
ইয়াকুব

পর্ব ১


এই সজীব, হাতমুখ ধুয়েছিস?
না রে, কয়টা বাজে?
সাড়ে সাতটা।
বাইরে কুয়াশা কেমন?
ঘন কুয়াশা। জানুয়ারি শেষ হলো আর শীতকাল মনে হচ্ছে নতুন করে আসছে। ঋতু বদলাচ্ছে। দেখিস এবার ফেব্রুয়ারিও শীতেই যাবে।
হ, কখন উঠলি ঘুম থেকে?
আজ সকাল সকাল জাগা পেয়েছি। একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলো। ফজরের নামায পড়ে একটু ঘুমুবো ভাবলাম, ঘুম আসলো না। চুপচাপ শুয়ে আছি।
স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গল মানে? দুঃস্বপ্ন নাকি? এই ঠাণ্ডায় গোসল করা লাগবে?
না, ওরকম কিছু না।
বলিস কী? সুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলে তো বিরাট ঠকেছিস। ঘুম না ভাঙ্গলে অনেকক্ষণ দেখতে পারতিস। ভালো লাগতো। দেখা যাচ্ছে তুই স্বপ্নে পড়ালেখা শেষ করে এসপি হয়ে গেছিস। এসি গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। বড়লোকের সুন্দরি মেয়ে বিয়ে করেছিস। আমি বেকার কোম্পানীর ম্যানেজার তোর বাসায় যাতায়াত করতে করতে তোর বউয়ের সাথে প্রেম শুরু করেছি। একদিন তোর বউয়ের সাথে শয়তানি করার সময় আমাকে হাতেনাতে ধরে হাজতে ঢুকিয়ে দারোগা দিয়ে পিটাচ্ছিস। তুই নানা রকম জরুরি কাজের ফাঁকে আমার দুর্দশা উঁকি মেরে দেখছিস আর মিটিমিটি হাসছিস। আমি দারোগার মার খেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে আছি আর তুই এসে আমাকে বলছিস, দেখলি আমার ক্ষমতা? বন্ধু ছিলাম বলে এখনো আমায় হাবাগোবা ভাবিস? মনে করেছিস আমার বউয়ের সাথে তুই টাংকি মারবি আর আমি হ্যাবলার মত চেয়ে চেয়ে দেখবো?
আমি ভীতু আর ফ্যালফেলে চোখে তোর দিকে তাকিয়ে থাকবো। আর তুই অট্টহাসি দিতে দিতে মন্ত্রী সাহেবের সাথে মিটিং করতে যাবি। তোর হাইফাই জীবন চলবে। সহজে ঘুম ভাংবে না। কারন ঘুম ভাংলেই দেখবি আমি তোর চাল নিয়ে রান্না করছি। দেখেও কিছু বলার সাহস পাচ্ছিস না। মনঃকষ্টের একটা পরিবেশ চলে আসবে। বাস্তবে তোর মত হাবার এসপি হবার সম্ভাবনা না থাকলেও স্বপ্নের জীবনটাকে দারুণ উপভোগ করতি।
আরে না রে দোস্ত, এরকম কিছু না। কোন সুস্বপ্নও না।
তাহলে?
আসলে বুঝতেছি না, সুস্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন?
বল দেখি শুনি, আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানি। অনেকগুলি সুলেমানি বই পড়েছি। যদি দেখিস কাক তোর মাথায় ঠুকরাচ্ছে তাহলে বুঝবি দুনিয়াতে তোর দুঃখ আছে। মাথার ব্যারাম হবে নয়তো দূর্ভিক্ষে মরবি। তোর মগজ শকুনে খাবে। সাপে তাড়া করলে বুঝবি পেছনে শত্রু লাগছে। বিবাহ দেখলে বুঝবি তোর গার্লফ্রেন্ড মরছে। যদি দেখিস ছাদ থেকে লাফাচ্ছিস, তাইলে বুঝবি পুরা জীবনই তোর ব্যর্থ। সফলতা পাবি না। যদি দেখিস শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাইলে বুঝবি তুই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবি। আর চোখ উল্টালে বিষ খাবি। কেউ হাত উঁচিয়ে ডাকলে বুঝবি মরণের চিঠি। ক্ষুধা লাগলে বুঝবি দুনিয়াতে তোর রিযিক শেষ। না খেয়ে বাঁচতে হবে বহু দিন। তৃষ্ণা লাগলে বুঝবি শেষ বয়সে সন্তানেরা তোকে যত্ন করবে না। পোড়া মাংস খেলে বুঝবি তোর হাগু খাওয়া রোগ হবে। ভায়াগ্রা দেখলে বুঝবি তোর বউ পরকীয়া......
থামতো।
আর শেষ রাতে যা দেখবি তাই সত্যি হবে। একদম হুবহু সত্যি হবে। বল শুনি, কী স্বপ্ন দেখলি ভোরে?
রাতে ফেসবুক চালাচ্ছিলাম। দেখলাম মামা তার বাচ্চার একটা ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছে। আর ক্যাপশন দিয়েছে, বাবু তিনদিন হলো তোমাকে দেখি না। খুব মিস করছি তোমায়। মামি তাতে কমেন্ট করেছে, তুমি কী পাষণ্ড পিতা! আমি হলে বুধবারেই ফিরে আসতাম। তিনদিন পরে ছেলের ছবি আপলোড করে ঢং দেখাচ্ছে। এরপর ঘুমালাম আর স্বপ্ন শুরু। স্বপ্নে আমি বারবার আম্মুর মলিন মুখ দেখলাম। আম্মুর এমন মলিন মুখ আমি কোনদিনই দেখিনি। আমি চোখ বন্ধ করে থাকছি তাও দেখতে পাচ্ছি। রাগে চোখে জোরে টিপ দিছি আর ঘুম ভাঙছে।
তোর আব্বু তো মারা গেছে?
হ, বছর কয়েক হলো।
সে জন্যেই তোর মাকে দেখেছিস। মরা মানুষ তোর দিকে মলিন মুখে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে- এরকম হলে তো চিল্লাপাল্লা করে আমারো ঘুম ভাঙ্গাতি।
ফাজলামি বাদ দে। তোর সুলেমানি জ্ঞানের কথা বল। দেখি কী শিখেছিস?
তোর বাড়ি থেকে আসা কয়দিন হলো?
এইতো, সাড়ে তিন মাসের মত।
এক কাজ কর। ক্যাম্পাসে তো অবরোধ চলছে। আজ ক্লাশ হবে না। নয়টার ট্রেনে বাড়ি যা। আবার সন্ধ্যায় ট্রেন ধরে চলে আসিস।
না, আজকে অবরোধে যাবো। আন্দোলন করবো। দাবি মেনে নিলে তবেই বাড়ি যাবো। একদিন ক্লাশ মিস হয় হোক।
তুই গরিব মানুষের ছেলে। ওইসব আন্দোলনে তোর যাবার কী দরকার? মারামারি হলে কী করবি? আন্দোলনের জন্য অনেক পোলাপান আছে। ওরা করবে।
আরে ধুর, ছেলেপেলে কারা আছে? সবাই গরীব। খুঁজে দেখিস ক্যাম্পাসে আমার থেকেও হাজারটা গরীবের ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে। কত ছেলে আছে যারা রিক্সা চালিয়ে পড়াশোনা করে। সেই দিনও এক ছেলে রাতে রিক্সা নিয়ে বের হইছে আর এক স্যার তাকে দেখে চিনতে পারছে। ছেলেটা লজ্জায় কাঁচুমাচু। আমিতো দুইটা টিউশনি করি। সবাই যদি ভয় করে বাড়ি চলে যায়, আন্দোলন করবে কে?
তাও এক কথা। ঠিক আছে থাক, দাবি আদায় করে ক্ষান্ত হ, বাড়ি যা।
দোস্ত, প্রতিদিন তুই রান্না করিস। আজকে আমি রান্না করি, তুই ঘুমা।
আচ্ছা কর, ভাত যেন পটপট না করে। ডাল সিদ্ধ করিস। আজ আলু ভর্তার বদলে ডাল ভর্তা খাই। রাতে ১০০গ্রাম ঘি এনেছি। ঘি দিয়ে মসুর ডাল ভর্তা করলে দারুণ লাগবে। টেবিলের কোণায় রেখেছি, দেখ। পলিথিনে মোড়ানো আছে। সাথে কয়েকটা শুকনো মরিচ ভাজিস। ঘিয়ের মধ্যেই ভাজিস।
ও খুব আগ্রহের সাথে আমার টেবিলের কোনা থেকে ঘিয়ের পলিথিন নিয়ে গেল। চাল ধুয়ে ভাত চড়িয়ে দিল। চুলার তারের আরেক মাথায় কোন প্লাগ নেই। দুই তারের মাথা সকেটের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিতে হয়। ও ছোটবেলায় এরকমভাবে ফ্যান চালাতে গিয়ে হাই ভোল্টেজের শক খেয়েছিল। সে ভয় এখনো কাটেনি। ভেজা হাতে সকেটে তার ঢুকানোর সাহস হচ্ছে না। আমতা আমতা করে বলল, দোস্ত, লাইনটা ওকে করে দে তো। হচ্ছে না কেন বুঝতেছি না।
আমি লেপের মধ্যে থেকে উঠে লাইন ওকে করে দিয়ে হাতমুখ ধুতে গেলাম। ফিরে এসে দেখি ও ঘি গলিয়ে একটা কৌটায় ঢেলেছে। এই কৌটায় করে ও বাড়ি থেকে আমের আচার এনেছিল। আচারের বেশিরভাগই আমি সাবাড় করেছি। চুরি করে খাওয়া লাগেনি। ও নিজেই আমাকে দিয়েছে। ওর নাকি আমের আচার খেতে ভালো লাগে না। ওর মা আচার বানিয়ে কৌটায় ভরে চুপ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আন্টির নাকি খিচুড়ির সাথে আমের আচার অমৃতের মত লাগে। আচারের আরো একটা বয়োম ট্রাংকে আছে। আশাকরি দুই এক দিনের মধ্যে ওইটা বের হবে।
আচ্ছা, তুই সুলেমানি বই পড়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা বাদে আর কিছু শিখিসনি? যাদু-বিদ্যা, মন্ত্র-টন্ত্র টাইপ কিছু?
হ, শিখেছি। শুনবি?
বল শুনি।
একটা ম্যাজিক শোন তাইলে। তোকে শিখিয়ে দেই। তোর এলাকার কোন এক দম্পতির নাম বল যাদের একজন মারা গেছে। কে মারা গেছে আর কে বেঁচে আছে আমি শুধু নাম শুনেই বলে দেব।
স্বামীর নাম- মোশাররফ আর স্ত্রীর নাম ফাতেমা।
স্ত্রী, তার মানে ফাতেমা মারা গেছে।
আরে হইছে তো!
হুম, আরেকটা বল।
তৈয়ব আর মরজিনা।
তৈয়ব।
বলিস কী! একদম সঠিক! কীভাবে পারলি, শিখাবি?
হুম। শোন তাহলে। নামের ‘অক্ষর’ আর ‘কার’ ও ‘ফলা’ নিয়ে খেলা। নামের প্রতি ‘অক্ষরের’ মান ধরবি ২, আর ‘কার’ বা ‘ফলার’ মান ধরবি ৩, তারপর যতগুলো অক্ষর আছে তাদের ২ দিয়ে গুণ করবি। ‘কার’ গুলোকে ৩ দিয়ে গুণ করবি। তারপর সবগুলো যোগ করবি। এভাবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামের হিসাব করে দুটো যোগফলের সমষ্টিকে ৩ দিয়ে ভাগ করবি। ভাগশেষ যদি ০ বা ১ হয় তাহলে ঐ দম্পতির স্ত্রী মারা গেছে। আর ২ হলে স্বামী মারা গেছে। ভাগফল কিন্তু নয়, ভাগশেষ। যেমন ধর, তোর বলা নাম,
মোশাররফ আর ফাতেমা
‘মোশাররফ’ এ মোট ‘অক্ষর’ আছে ৫ টি, তাহলে সূত্রমতে, ৫*২=১০, আর ‘কার’ আছে ২ টি, তাহলে- ২*৩=৬, এবার মোট যোগফল হবে, ১০+৬=১৬।
এবার ‘ফাতেমা’ তে ‘অক্ষর’ আছে ৩ টি, ৩*২=৬, আর ‘কার’ আছে ৩টি, ৩*৩=৯, যোগফল, ৯+৬=১৫।
এখন, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মানের সমষ্টি, ১৬+১৫=৩১, একে ৩ দিয়ে ভাগ করলে ভাগশেষ হয় ১, অর্থাৎ এই দম্পতিতে স্ত্রী মারা গেছে।
তৈয়ব আর মরজিনাতে, ‘তৈয়ব’ এর মান হবে, ৬+৩=৯, আর ‘মরজিনা’তে, ৮+৬=১৪, মোট হচ্ছে, ৯+১৪=২৩/৩, তাহলে ভাগশেষ হচ্ছে ২, এই দম্পতিতে স্বামী মারা গেছে। বুঝলি এবার ম্যাজিক?
ইয়াকুব কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর অবাক হয়ে বলল, আরে তাইতো! সব তো মিলে যাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব?
ও চুলার দিকে নজর না দিয়ে খাতা কলম নিয়ে বসে পড়ল। এক দম্পতির হিসাব করে মিলল না। ইয়াকুব হতাশ হয়ে গেল।
কী ব্যাপার? হিসাবে ভুল করলাম নাকি?
না, হিসাবে ভুল করিসনি। এই সূত্র ৮০-৯০% ক্ষেত্রে কাজ করে। অনেক দম্পতিতে কাজ নাও করতে পারে। ইয়াকুব খাতা কলম ফেলে চুলার কাছে এসে বসল।
আর কিছু জানিস?
হুম, একটা মন্ত্র জানি। স্বামী বশ করা মন্ত্র।
খুবই ইন্টারেস্টিং। স্ত্রী বশ করারটা জানলে আরো মজার হতো। আচ্ছা বল, এইটাই শুনি।
স্ত্রী বশ করার কোন মন্ত্র নাই। কোন তান্ত্রীক এই ঝামেলায় কোনদিন পড়ে নাই। যা ঝামেলা সব স্ত্রীদের, তাদের স্বামীদের নিয়ে।
অবাধ্য স্বামীকে বশ করার জন্য স্ত্রীকে তার মাসের প্রথম রক্তস্রাবের ব্যবহৃত ন্যাকড়া ভাত রান্না করার চুলায় আগুনে পুড়াতে হবে। তারপর ওই ছাই রান্না শেষে ভাতে মেশাতে হবে। সেখান থেকে প্লেটে করে এক চামচ ভাত নিয়ে কুকুরকে ‘আ তু’ বলে ডেকে খেতে দিতে হবে। অথবা লোকাল ভাষায় কুকুরকে ডেকে ওই খাবার দিতে হবে। তারপর কুকুরকে খেতে দেয়া ওই প্লেটের কিছু ভাত রেখে দিতে হবে। অর্থাৎ কুকুরের এটো করা ভাত রেখে দিতে হবে। আর স্বামী কাজ থেকে বাড়ি ফিরলে তাকে ওই প্লেটে হাঁড়ি থেকে ভাত নিয়ে কুকুরের এটো ভাতের সাথে মিশিয়ে ঠিক কুকুরকে যেমন আদর করে ডেকে খেতে দেয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই স্বামীকেও আদর করে ‘আ তু’ বা লোকাল ভাষায় ডেকে খেতে দিবে। ওই ভাত যদি স্বামী এক লোকমাও গিলে তো সারা জীবন বউয়ের আঁচল ধরে থাকবে।
ছি ছি। এটা কেমন ধরনের মন্ত্র? যদি না গিলে তো? বা স্বামী যদি বুঝে ফেলে?
তাহলে যা হবার তাই হবে। এই মন্ত্রের ক্ষেত্রে স্ত্রী’র হাই রিস্ক থাকে। তবে এটি কারেন্টের মত কাজ করে। গ্রাম বাংলার নারীরা তাদের স্বামীদের এভাবে যুগ যুগ ধরে...
চুপ কর। তোর এইসব বাজে মন্ত্র শেখার ইচ্ছা আমার একদম নাই।
ইয়াকুব চিন্তায় পড়ে গেছে। ওই নিজে এই খপ্পরে পড়ে কিনা তা ভাবছে মনে হয়। এই মন্ত্রের কথা মনে থাকলে শালা জীবনে বউকে জালাবে না।
ইয়াকুব মসুর ডালে ঘি ঢালতে ঢালতে বলল, সজীব, বলতো সর্বশেষ কবে ঘি মাখিয়ে মসুর ডালের ভর্তা খাইছিস?
মনে নেই। তবে মুসলমানি দিয়ে খাইছিলাম তা মনে আছে।
আমিও। আমার মুসলমানি দেয়ার পর ইয়ের ঘা শুকাতে দেরি হয়েছিল। তাই আম্মু মনে করেছিল ভর্তাতে ঘি কম হচ্ছে। তারপর ঘিয়ের পরিমান ক্রমেই বাড়ছিল আর টেস্টও বাড়ছিল। বারো দিন এভাবে খাইছিলাম। পরে যখন আর দিলো না তখন মনে হলো- ইশ, প্রতিদিন মুসলমানি হয় না কেন?
ঠিক আছে, তুই মেডিকেল থেকে আবার মুসলমানি দিয়ে আয়। কথা দিলাম ৭ দিন আমি তোকে নিজে হাতে ঘি দিয়ে ডাল ভর্তা করে খাওয়াবো।
ধুর, আমার আম্মুর মত ভর্তা তুই কোনদিনই করতে পারবি না। ফাইভ স্টার হোটেলের বাবুর্চির কাছে প্রশিক্ষণ নিলেও না। চল, একদিন আমার বাসায়। ভর্তার সেন্ট দিয়ে তোর চোখ বন্ধ করে দিব।
ওকে, আগে মুসলমানি দিয়া নেই। আমার ইয়ের ঘা শুকাতে দেরি হলে তোর বাড়ি গিয়ে ভর্তার সেন্ট নিয়া আসমুনে।
ইয়াকুব থেমে থেমে পরপর দুইটা হাই তুলল। একটা হাই তোলার পর সাথে সাথে আরেকটা হাই কেমনে আসে কে জানে। দুই নম্বর হাই এর ডিউরেশন একটু বেশি হলো। হাই শেষ না হতেই জিহবা জড়িয়ে ইয়াকুব কথা বলা শুরু করলো।
তুই কোন স্বপ্ন দেখিস না?
কেন দেখবো না? দেখি তো।
গল্প শোনা তো। কেমন স্বপ্ন দেখিস শুনি।
আমার স্বপ্ন সব ভৌতিক টাইপ হয়। তোর তো ভয় লাগবে।
আরে, আমি প্রতি শুক্রবার রাতে ভূত এফ এম শুনি। ভয় পাই, মজা লাগে।
ভূত এফ এম কী?
আরে, রেডিও ফূর্তির রাসেল ভাইয়ার একটা প্রোগ্রাম। অনেক মজার। ভূতের আজগুবি সব গল্প শোনায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষ। এরা কোন না কোন ভাবে ভৌতিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে।
তাই নাকি? রিয়েল কাহিনী নিয়ে?
হ।
বলিস কী! তার মানে সত্যি সত্যি ভূত বলে কিছু আছে নাকি?
কেন? তুই ভূতে বিশ্বাস করিস না?
করতাম না। ছোটবেলায় মা বই দেখে দেখে ভূতের গল্প পড়ে শোনাতো। ওইটা যে আসলেই আছে তা তো কোনদিন বলেনি। আমি জানতাম ভূতের গল্প আছে। ভূত আছে জানতাম না। কিন্তু কেউ দেখে থাকলে আর বিশ্বাস না করে উপায় কী? করলাম বিশ্বাস।
আচ্ছা তোকে বিশ্বাস করতে হবে না। এখন তোর একটা ভৌতিক স্বপ্নের কথা বল, শুনি।
স্বপ্ন নয়। তোকে আমি আমার জীবনে ঘটা একটা সত্য কাহিনী বলব। ভৌতিক নাকি জানি না। তবে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম এমনটায়।
আচ্ছা, এখন থাক। রাতে বলিস। ঘুমানোর আগে আলো বন্ধ করে শুনবো। ভয়ে শিউরে উঠবো। এখন শুনলে ভৌতিক কথাকেও হাসির মনে হবে। আর রাতের আন্ধারে গল্প বলার সময় টেবিল থেকে কলমের ক্যাপ পড়ে গেলেও পিলে চমকে যাবে। 

Monday, January 6, 2020