Tuesday, June 22, 2021

অতৃপ্তি (পর্ব ৩)

 বীথীর সাথে ইয়াকুবের পরিচয় একরামুল স্যারের সূত্রে। একরামুল স্যার ইয়াকুবের এলাকার মানুষ। ইয়াকুব মাঝেমধ্যে স্যারের বাসায় বেড়াতে যায়। স্যারের বউ ইয়াকুবকে খুব পছন্দ করে। ইয়াকুব হাবাগোবা, সরল-সহজ ছেলে, সে জন্য নয়। সে ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে পারে, সে জন্য।

মোমিন নামের এক লোক স্যারের বাসায় কাজ করে এটা আমি শুনলাম ইয়াকুবের থেকে। লোকটা নাকি খুব গরীব। স্যার দয়াপরবশ হয়ে তাকে বাড়িতে কাজ দিয়েছেন। মোমিনের কাজ হলো- সকাল বেলা স্যারের বাসায় আসা আর বাজার-সদায় করে দেয়া।

স্যারের ছোট সংসার। বাজার করার জন্য আলাদা মানুষ রাখার কোন দরকার নেই। তারপরও স্যার রেখেছেন। কেন রেখেছেন আমি জানি না। তবে ইয়াকুবের মতে, স্যার অমায়িক ধরনের একটা মানুষ। স্যারের বৌও তাই। মাস শেষে মোমিনকে একরামুল স্যার ৫ হাজার টাকা বেতন দেন। স্যারের বউ- বীথীর মাকে, বীথীকে নিজের পুরনো শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করেন। এতে অবশ্য ম্যাডাম নিজে নতুন কেনার একটা বাহানায় আসতে পারেন। স্যার নাকি পরিকল্পনা করছেন, মোমিনের পচা পুকুরটা কিনে নিয়ে তাতে একটা ছাত্র মেস বানাবেন। আর মোমিনকে তার ম্যানেজারি দিয়ে দিবেন। তাহলে মোমিনের একটা ভাল আয়ের ব্যবস্থা হবে। স্যারের সংসারেও বাড়তি ইনকামের একটা সোর্স হবে।

এই মোমিনের একটাই মেয়ে, বীথী। পড়ালেখায় নাকি মারাত্তক। কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে জানি না। ফার্স্ট ইয়ারে নাকি ফার্স্ট হয়েছে। বীথীর উপর স্যারের নজর খুব কড়া। পড়ালেখা ঠিকমত করে কিনা- নিয়মিত খোঁজ খবর করেন। নোটপত্র, বই-পুস্তক যখন যা লাগে সব স্যার কিনে দেন। মোমিনকে কোন টাকা খরচ করতে হয় না। নিজের মেয়ের মত বীথী কে স্যার স্নেহ করেন। মোমিনের পরিবারের যে কেউ স্যারের বাসায় নিজের মত আসা-যাওয়া করে।

ইয়াকুব একদিন স্যারের বাসায় গিয়ে ম্যাডামের সাথে কথা বলছে। ছন্দ মিলাচ্ছে। ম্যাডাম হেসে কুটিপাটি। তো ইয়াকুব ছন্দ মিলাতে গিয়ে কোথায় যেন ‘তিথি’ বলেছে। আর এ সময় বীথী এসে ঘরে ঢুকেছে। সে তিথি শব্দটাকে বীথী শুনেছে। বীথী ভেবেছে তাকে নিয়ে ইয়াকুব মশকরা মারছে। ইয়াকুব নাকি বীথীর কথা তখনো জানতো না। আগে যতবার স্যারের বাড়ি গিয়েছে বীথীর সাথে কখনোই তার দেখা হয়নি। এমনকি বীথী নামের এক মেয়ে যে স্যারের বাড়ির সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ তাও সে জানতো না। তবে মোমিন কে নাকি চিনত ইয়াকুব।

ইয়াকুবের ভাষায়- বীথী অনেক চটপটে মেয়ে। তবে বীথী তখন ইয়াকুবকে কিছু বলেনি। শুধু চোখ বড় করে নাকি তাকায়ছিল একবার।

এখান থেকে বীথীর সাথে ইয়াকুবের পরিচয়। পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে দেখা হলে কথা হতো। আর স্যারের বাসায় গেলে মাঝেমাঝে চোখাচোখি।

শালা হাবা ইয়াকুব বলে, আমি তো জবান বন্ধ হয়ে ছিলাম বীথীর চক্ষু দেখার পর। এই মেয়ে কি মানুষ? নাকি আমার স্বপ্ন? ঠাহর করতে পারিনি তখন। আমি তো আবার এমনভাবে স্বপ্নে থাকি, মনে হয় রিয়েল লাইফেই আছি। স্বপ্নকে রিয়েল লাইফের সাথে পৃথক করতে পারি না।

মামি আমাকে বললেন, ইয়াকুব? তোমার দেখা একটা সুন্দর স্বপ্ন বলোতো। তোমার মা বলে, তুমি নাকি অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখো। বলোতো একটা শুনি।

আমি স্বপ্নের গল্প বলতে শুরু করলাম। বীথী রান্না ঘরে পেঁয়াজ-রসুন কাটছে। সে যে এখন আমাদের কথায় কান পেতে আছে বুঝতে পারছি। এবার ‘তিথি’ ‘বীথী’ তে ঝামেলা করলে বটি হাতে চলে আসবে।

 

(স্বপ্ন)

সেদিন স্বপ্নে, খুব সুন্দর একটা মানুষকে দেখেছি। মুখভর্তি লম্বা দাড়ি, ফরসা টকটকে। লোকটির স্ত্রী আর একটি কন্যা রয়েছে। স্ত্রীটিও বেশ সুন্দরী। তবে লোকটির চেয়ে অনেক কম। কন্যাটি ক্লাস ফাইভে পড়ে- এরকম বয়স। দেখতে কালো, বেশি সুন্দরী নয়। বাবা-মায়ের রুপ পায়নি।

এই লোকটির একটা স্পেশালিটি আছে। সে তার মত আরো তিনটি অবয়ব বানিয়ে রেখেছে। দেখে কারো পার্থক্য করার উপায় নেই। কোনটি জীবন্ত আর কোনটি অবয়ব।

আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে লোকটির বাড়িতে তার এই অলৌকিক ক্ষমতা দেখতে এসেছি (বন্ধুরা কারা ছিল মনে করতে পারছি না)। লোকটির বাড়ির ভেতর ঢোকার পর দেখলাম একটা ঘরে লোকটি তার স্ত্রী-কন্যা সহ একটা বাথটাব আকৃতির পাত্রের মধ্যে শুয়ে আছে। পাত্রটি মেলামাইনের বা চিনামাটির তৈরী হবে। সাদা রঙয়ের। চকচক করছে। ঘরের দেয়ালগুলো মনে হচ্ছে চিনামাটি বা কাঁচ দিয়ে প্রলেপ দেয়া। সাদা আলোর প্রতিফলন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সরাসরি দেয়ালের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বাথটাবে একপাশ ফিরে তার স্ত্রী আর বাবা-মায়ের সামনে মেয়েটি বসে আছে। মায়ের সাথে কী সব বলছে আর হেসে কুটিকুটি টাইপ অবস্থা। আমাদের দেখে লোকটির বউ উঠে বসল। মেয়েটি পাত্র থেকে নেমে নিচে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটির পরনে সালোয়ার-কামিজ। খয়েরি রঙয়ের। একদম সাদামাটা। কোন চাকচিক্য নেই। চেহারাতেও না, পোশাকেও না।

লোকটির বউকে দেখে আনমনেই 'ওয়াও' বললাম। অনেক সুন্দরী আর স্বাস্থ্যবতী মহিলা। বোরখা টাইপ মহিলাদের একটি পোশাক পরে আছে। নাম জানি না। মেক্সি হবে হয়তো। চুল ঝুঁটি করে বাঁধা।

লোকটি বাথটাব থেকে বের হলো তার বউয়ের নেমে আসার পরে। অদ্ভুত সুন্দর লোকটি। বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে হবে। খালি গায়ে একটি লুঙ্গি পরে আছে। ঝাঁকড়া চুল আর মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। নুরানি চেহারা বলা যায়। পেটে হালকা ভুড়ি নেমেছে। তবে গায়ে কোন মেদ নেই। টানটান চামড়া। পুরো শরীর চকচকে। যেন সাদাটে চিনামাটি দিয়ে লেপে দেয়া। ঘরের সাদা আলোর প্রতিফলন যেন দেয়ালের চেয়ে এই মানুষটার থেকে বেশি হচ্ছে। এই লোকের সৌন্দর্যের কাছে তার বউ কিছুই নয়।

 

বলো কি? তুমি স্বপ্নে আলোর ঝলকানি দেখছো?

জি, মামি।

তোমার মা আসলেই ঠিক বলে। এটা তো অদ্ভুতই। আমি তো চোখ বন্ধ করলেই আন্ধার দেখি। আর তুমি শুধু আলো না, আলোর ঝলকানি দেখছো! আচ্ছা বলতে থাকো...

 

আমরা তাকে কিছু বলার আগেই আমাদের বলল, আসো বাবারা। আমরা কোন কথা না বলে ভেতরে গেলাম। ঘরের পেছন দিকে আরেক অংশ। পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা। এই অংশটা বেশ বড় আর প্রশস্ত। তবে দেয়ালের রঙ আর নির্মাণশৈলি একই। শুধু বাথটাবটা নেই। এখানে তিনটি লম্বা বেঞ্চে বানানো তার নিজের তিনটি অবয়ব শোয়ানো। একদম লোকটির মত। হুবহু। অবয়বগুলির নাভী থেকে নিচের পুরো অংশ কাপড় দিয়ে ঢাকা। উপরের অংশ খোলা। আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি যেন তিনজন হয়ে তিন বেঞ্চে শুয়ে আছে। পরপর তিনটা বেঞ্চের পরে আরেকটি বেঞ্চ খালি রয়েছে। লোকটি কোন কথা না বলে সেই বেঞ্চে অবয়বগুলির ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। বলল, তোমরা এবার চোখ বন্ধ করো। আর আমি কথা বলা বন্ধ করার দশ সেকেন্ড পর চোখ খুলবে। বলবে, কোনটা আসল- আমি। আমরা চোখ বন্ধ করলাম। লোকটা আমাদের শুনিয়ে কিছু কথা বলল। মন্ত্র টাইপ মনে হলো। সবগুলা মনে নাই, তবে ভাসা ভাসা মনে আছে।

আমি আছি আমি থাকি

এই আছি এই থাকি,

যেতে চাই চলে যাই

না চাই থেকে যাই।

তারপর আরো অনেক কথাই বলল। এই চার লাইনের পরে আর মনে নাই কিছু। শেষের লাইনটা মনে আছে শুধু। বলল,

গেলাম আমি তাইতো...

তারপর আর কোন কথা শুনলাম না। এই লাইন বলার দশ সেকেন্ডের মাথায় আমরা চোখ খুললাম।

 

মানে তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেল? মামি বললেন।

আরে না, স্বপ্নেই আমরা চোখ খুললাম।

ও আচ্ছা।

দেখি চারটা অবয়বই একইভাবে তাকিয়ে, একইভাবে হা করে আছে। গায়ের লোমগুলোও একই রকম। এমনকি শরীরে যেখানে যে তিলগুলো আছে তাও সবগুলোতে এক রকম। বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। আমরা সবাই বুঝতে পারছি যে, লাস্ট বেঞ্চের লোকটাই আসল। বাকিগুলো নকল। কিন্তু এই চারটা জিনিসের মধ্যে পার্থক্যটা আসলে কী? এদের থেকে আসল মানুষটাকে আলাদা করা একদমই সম্ভব নয়। চারটা বেঞ্চে থাকা চারজনই একরকম। চুল পর্যন্ত কমবেশি নেই। আমরা তাকে চোখ বন্ধ করার আগে শেষ বেঞ্চে শুতে দেখেছি, তাই জানি যে ওটাই আসল। কিন্তু না দেখলে পার্থক্য করা সম্ভব নয়। আমরা সবাই অবয়বগুলি নিখুঁতভাবে দেখলাম। কেউ কোন পার্থক্য করতে পারলাম না। আমরা বললাম যে আসল আপনি উঠে আসুন। আমরা আপনাকে খুঁজে পাচ্ছি না। লোকটি তিন নম্বর বেঞ্চ থেকে উঠে আসলো। আমরা তো পুরাই থ! লোকটি বলল, দেখলে তো। আসল আমাকে চার নম্বর বেঞ্চিতেই ভেবেছিলে। কিন্তু ওটা আমি নই। আমার কাজ কত নিখুঁত দেখেছো? আমরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।

 

আচ্ছা ইয়াকুব, তুমি কোন জাদুমন্ত্র দিয়ে আচ্ছন্ন না তো? আমার মনে হয় তোমাকে কবিরাজ দেখানো দরকার।

আমার স্বপ্ন শুনে আম্মু একবার নিয়ে গেছিলো নান্নু কবিরাজের কাছে। নান্নু বাবা জিন হাজির করে, চাল পুড়িয়ে, বাটি চালিয়ে বলেছিলেন বাচ্চার উপর কোন জাদুর প্রভাব নাই।

তোমার মা কোন ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি?

ডাক্তার ও দেখিয়েছিলেন। হরিকাকুকে।

হরিকাকু কে? কিসের ডাক্তার?

হরিকাকু হলেন আমাদের এলাকার বিখ্যাত ডাক্তার। কাকুর ডাক্তার হবার পেছেনে রয়েছে বিরাট ইতিহাস। গ্রামে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে উপজেলা থেকে লোকজন এসে পুরো গ্রাম ঘুরে কয়েকজনকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে হরিকাকু তখন একমাত্র মেট্রিক পাশ করা ছাত্র ছিল। পাশের গ্রামের কয়েকজনও গিয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ পরে ডাক্তারি বিদ্যার কাজ করার সাহস পায়নি, মেধায় কুলায়নি। তারা সবাই প্রশিক্ষণ ছেড়ে ফিরে এসে মাঠে কাজ শুরু করে। হরিকাকু নাকি সেসময় অতি সাহসীকতা ও মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করে  গ্রামে ফিরেন। ডাক্তারি শুরু করেন।

হরিকাকু যে কী পরিমাণ সাহসী তার একটা নমুনা দেই। একবার গ্রামে পোলাপান হরিকাকুর পুকুরে লাফঝাঁপ করছিল। পাড় থেকে দল বেধে পুকুরে ঝাঁপ দিচ্ছিল। পুকুরে হরিকাকু বাঁশ পুতে রেখেছিলেন যেন, চোর জাল ফেলে মাছ ধরতে না পারে। এক পিচ্চি উপর থেকে পানিতে লাফ দিয়ে এমনভাবে সেই বাঁশের উপর পড়েছে যে, পেটের একপাশের চামড়া ফেঁসে গিয়ে ফাঁক হয়ে গেছে। ভেতরের ভুড়ি দেখা যাচ্ছে। পোলাপান পিচ্চিটাকে ধরে হরিকাকুর কাছে নিয়ে এসেছে। হরিকাকু এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে সাথে সাথে ফিট হয়ে গেছেন। চোখেমুখে পানি দিয়ে, মাথায় পানি ঢেলেও কাকুর জ্ঞান ফেরানো যায়নি। পরে পেট কাটা পিচ্চিসহ কাকুকে হুলস্থুল করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে দু'জন বেঁচে ফিরে। পিচ্চিটার পেটের শুধু চামড়া কেটে গিয়েছিল। ভেতরের নাড়ি-ভুড়ির কোন ক্ষতি হয়েছিল না। পিচ্চির পেটে আটটা সেলাই পড়েছিল।

এই তোমার ডাক্তার কাকু?

জি মামি।

তো তোমাকে কী ট্রিট দিয়েছিল, শুনি?

বলেছিলেন, বাচ্চার গভীর ঘুম হয় না। আবছায়া ভাবে ঘুমায়। সেজন্য এরকম হয়। অল্প পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। খুব ঘুমাইছিলাম সে কয়দিন।

তখন এরকম আজিব স্বপ্ন দেখনি?

মনে নাই। আম্মু বলত, ঔষুধ খেলে নাকি মরার মত পড়ে থাকি। যদি সত্যি সত্যি মরে যাই- সেই ভয়ে পরে আম্মু আর ঘুমের ঔষুধ খেতে দেয়নি।

আচ্ছা, বলো তোমার স্বপ্ন। তারপর কী হলো?

 

লোকটি বলল, এবার বাইরে যাও। আমার মেয়ের কেরামতি দেখে আসো। মেয়েটির কেরামতি দেখতে সবাই বাইরে গেল। আমি শুধু থেকে গেলাম লোকটার কাছে।

লোকটা আমাকে বলল, তুমি কিছু বুঝেছো নাকি? কোন ক্লু পেয়েছো?

আমি বললাম, কিছু মনে করবেন না। আমি একটা জিনিষ ধরতে পেরেছি। যা আপনাকে এই তিনটি অবয়ব থেকে আলাদা করছে। এই দেখুন, আপনার বুকের বামপাশে একটা তিল আছে, তার উপরে একটা ছোট কালো স্পট আছে। যা দেখতে তিলের মত মনে হলেও তিল নয়। এই স্পটটি আপনার গায়েরটা একটু গাঢ়। আর বাকি তিন অবয়বে হালকা। একটু সাইজে ছোটও হবে। আমি কি ঠিক বলেছি? এই সময়ের মধ্যে আমি আপনার সাথে অবয়বগুলির আর কোন অমিল ধরতে পারিনি।

লোকটি বলল, ঠিক বলেছো বাবু। তবে কেউই ওইটুকু বুঝতে পারে না। সবাই অবাক চোখে মুগ্ধ হয়ে দেখে। অত ভুল ধরার চিন্তা মাথায় আসে না। সবাই ভাবে এটা অলৌকিক। আর এতে কোন ভুল নেই। ধরার চেষ্টা করেও লাভ নেই।

আমি বললাম, যাই হোক, আপনার এই জিনিষ যদি আপনার হাতেই হয়ে থাকে- তাহলে সত্যি অসাধারণ। তিনটা বস্তু নিজের আকৃতির মত করে সবগুলোই এত নিখুঁতভাবে বানানো হেভি প্রশংসার যোগ্য। মনে হচ্ছে আপনি স্ক্যান মেশিনে ঢুকে স্ক্যান হয়ে এসেছেন। আসলে এত নিখুঁত কাজের কাছে এই স্পটের সাইজ কোন ভুল নয়। আর বানানো তিনটিতে তো কোন পার্থক্য নেই। আসলে, ঘটনাটা কী আমাকে বলবেন? তিনটা একই জিনিষ আলাদাভাবে কোন একই মানুষ হাত দিয়ে এত নিখুঁত ভাবে সবগুলো হুবহু একইরকম তৈরি করতে পারবে- তা আমার বিশ্বাস হয় না।

 

তুমি কি কোন মন্ত্র জানো, ইয়াকুব?

আমি জানি না, তবে আমার রুমমেট জানে।

ও মাঝেমাঝে আমাকে অনেক কিছু বলে। আসলে ও খুব টাউট ছেলে। বানিয়েও বলতে পারে। আমার বিশ্বাস হয় না ওকে।

আচ্ছা বাদ দাও। স্বপ্নের কথা বলো। তারপর কী হলো?

 

লোকটি বলল, এটা আসলে স্ক্যান করা।

ওয়াও! তাইতো। এরকম হতেও তো পারে। স্ক্যান মেশিন, ফটোকপি মেশিন এসব তো কত আমাদের আশেপাশে। মামি বললেন।

না, মামি। এই স্ক্যান আমাদের আশেপাশের স্ক্যান থেকে আলাদা। আমরা কাগজের লেখা স্ক্যান করি। কিন্তু কাগজকে তার মত করে স্ক্যান করতে পারি না। যেমন ধরেন, একটা রডের ছবি কাগজে আছে সেটা স্ক্যান করলাম। কিন্তু রডকে কিভাবে স্ক্যান করবেন? যা স্ক্যান করার পর আবার একই রকম আরেকটি রডের মত প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসবে। ব্যাপারটাকে আসলে ক্লোন টাইপ বলতে পারেন।

হ্যাঁ, তাই তো। এটা আবার কী জিনিষ? অদ্ভুত তো! মামি কৌতুহলি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন পরবর্তী ঘটনা শোনার জন্য।

বীথী রান্না ঘর থেকে পিঁয়াজ হাতে বের হয়ে আসলো। বলল, আন্টি, এটা থ্রিডি টেকনোলোজি। এরকম প্রিন্ট বিদেশে হয়। আমাদের দেশে এখনো চালু হয়নি।

আরে প্রিন্ট হয় বুঝলাম। এরটা তো স্ক্যান। ক্লোন টাইপ। অন্য মামলা। মামি বীথী কে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আচ্ছা তুমি বলতে থাকো স্ক্যানের কাহিনী। তারপর কী দেখলে?

 

এই লোক এক গবেষণাগারে কাজ করতো। সেখানে অদ্ভুত এক স্ক্যানার আবিষ্কার করেছে অন্য এক লোক। সেই স্ক্যানার দিয়ে কোন বস্তুকে স্ক্যান করে হুবহু প্রিন্ট করা যায়। আবিষ্কারক লোকটি ছিল সেই গবেষণাগারের ঝাড়ুদার। লোকটির সাথে সে অনেক দিন ছিল। মেশিনটি বানানোর পর ঝাড়ুদারের কথায় সে প্রথম সেই মেশিনে ঢুকে স্ক্যান হবার জন্য। মেশিনে ঢুকে যেভাবে তাকিয়ে ছিল ঠিক সেভাবেই সে স্ক্যান হয়ে প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসে। তার তিনটা অবয়ব প্রিন্ট করেছিল ঝাড়ুদার। পরের রাতে সেই ঝড়ুদার রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। সে যন্ত্রটা আর কেউ চালাতে পারেনি। আর সে ঝাড়ুদার কাউকেই তা ব্যবহার করা শিখিয়ে যায়নি। তার কাজের কোন কাগজপত্রও ছিলো না। পরে ভেতরে আমার এমন তিনটি অবয়ব দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, এগুলো কে বানিয়েছে? আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, আমি। সবাই থ হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকলো। ভাবলো আমি অলৌকিক কিছু। এমন জিনিষ মানুষের হাতে বানানো সম্ভব নয়। এটা কিভাবে বানাইছি কেউ আমাকে আজো জিজ্ঞাসা করেনি। সবাই দেখে আর হা হয়ে চলে যায়। একমাত্র তুমি জিজ্ঞাসা করলে। এর ঘটনাটা আসলে কী?

আমাদের কথাবার্তার মধ্যে লোকটির বউ ভেতরে আসলো। দেয়ালের একটা অংশ খুলল। চারকোণা পাল্লা টাইপ। দেয়ালের গায়ে মিশে ছিল। ভেতরে আলমারি। তার ভেতরে বুক সেলফ রাখা। অনেকগুলো মোটা মোটা বই সাজানো তাতে। দুটো বই নিয়ে আবার দেয়ালের খুলে নেয়া সেই অংশটা লাগিয়ে দিল মহিলাটি। দেয়াল আগের মতই মসৃণ হয়ে গেল। আমি মহিলার পেছন পেছন বাইরে আসলাম।

দেখি, পিচ্ছি মেয়েটা ভীতু চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। ওর মা বই বের করে কী সব পড়ছে। এই মেয়েটার তার বাবার মত ভেলকি লাগানোর স্পেশালিটি আছে। তার হিন্দু ধর্মের সবগুলা ধর্মগ্রন্থ মুখস্ত। হিন্দু ধর্মের সমস্ত নিয়ম কানুন সবকিছু রেফারেন্স সহ বলে দিতে পারে চট করে। একজন লক্ষী পূঁজা আর সরস্বতী পূঁজার কী যেন নিয়ম ধরেছে। মেয়েটা ভুল করে উল্টোটা বলে ফেলেছে। লক্ষী পূঁজার নিয়মকে সরস্বতী আর সরস্বতীকে লক্ষী পূঁজার সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। আমাদের মধ্যে একজন হিন্দু ছিল সে ব্যাপারটা ধরেছে। বলেছে, বাবু তোমারটা ভুল হয়েছে। প্রথমে মা-মেয়ে দু'জনেই মানেনি। তারা বলেছে, আমরা ঠিক। আপনিই ভুল। পরে আমাদের বন্ধুরা সবাই মিলে বলেছে- ও হিন্দু। ব্যাপারটা আপনি ভালো করে দেখেন। তাই মাহিলাটি ভেতরে বই আনতে গিয়েছিল। এখন পাতা উল্টে পাল্টে পিচ্চিকে বলল- মা, তোমারই ভুল হইছে। তুমি উল্টোটা বলে ফেলেছো। মেয়েটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, হতে পারে তাহলে। ভুল করে ফেলেছি। একটার সাথে আরেকটা গুলিয়ে ফেলেছি।

এখন মা-মেয়ে দু'জনই আমাদের দিকে লজ্জিত চোখে চেয়ে আছে।

আমি বললাম, এই পিচ্চি মেয়ে যে এতগুলা বই পড়েছে, মনে রেখেছে- তা কম কী? একটু আধটু ভুল হতেই পারে। আমরা মুসলমানেরা তো কিছুই পড়ি না। একটা মাত্র ধর্ম গ্রন্থ। তাও পুরাটা কয়জন পড়ে? মনে রাখা তো দূরের কথা (হাফেজদের কথা ভিন্ন)। আর হিন্দু ধর্মে তো অনেক গ্রন্থ। আর যে সাইজ একেকটার! পড়ে শেষ করাই কঠিন। আর মনে রাখা? বাপরে!

এমনভাবে আমি বলছিলাম, যেন তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আসলে ওরা মুসলমান পরিবার। তবে লোকটির দাড়ি-গোফের সাইজ দেখে শিক মনে হচ্ছিল।

চলবে...