[*লিটল বয়, আমেরিকান মুভি। মুভিটির হিরো এক পিচ্চি বাচ্চা। বাচ্চাটা তার যুদ্ধে যাওয়া বাবাকে ফিরে পাওয়ার আশায় এক অদৃশ্য বিশ্বাস নিয়ে বুক বেঁধে থাকে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তার বাবার মৃত্যু সংবাদ আসার পরেও সে আশাহত হয় না। বাবা ফিরে আসবে, আসবেই! বাচ্চাটার এ যুক্তিহীন বিশ্বাসের গভীরতা ও প্রিয় বাবার জন্য পথ পানে এই অবুঝ শিশুর অনর্থক অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকার কাহিনী যে কোন কঠিন হৃদয়কে কাঁদিয়ে ফেলবে।
.*আয়েশা-লিও, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের বিখ্যাত উপন্যাস 'শী' এবং 'দি রিটার্ন অফ শী' এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। অপূর্ণ একটি প্রেমে তাদের দুই জনের জীবনের ত্যাগের মহিমা যে কারো হৃদয়কে হাতে ছুঁয়ে নেড়ে দিবে।]
আমি তখন বালক। কিশোর হয়তো। বয়সটা মনে নেই। নারী জাতিকে আমি ছোটবেলা থেকে যে রকম দেখে এসেছি তাতে যেকোন মেয়ের প্রতি রাগ আর ঘৃণা ছাড়া কিছু জন্মেনি আমার। জানি না, আমার জীবনটাতে নারীরা এভাবে আবির্ভূত হয়েছে কেন?
যখন বড় হতে শুরু করলাম, বুঝতে শিখলাম তখন দেখলাম আমার কাছে নারীদের এমন ঘৃণিত হবার পেছনে পুরূষ সমাজের বেশ দ্বায় আছে। তবে পুরুষের যতটা না দ্বায় আছে তার থেকে নারীদের দ্বায়টা বেশি- তাদের এমন ঘৃণার পাত্র হওয়ার পেছনে।
একজন ছেলে আর একজন মেয়ে একই পরিবেশে বড় হলেও তাদের দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকে। আমি শারীরীক পার্থক্যের কথা বলছি না। মানসিক পার্থক্যের কথা বলছি। জানি না, আমার দেখা সেই নারী জাতী আসল নারী কিনা?
বই-পুস্তক, ইতিহাস-পাতিহাস যা কিছু পড়ি সব কিছুতেই মূল ধ্বংসের পেছনে কোন না কোন নারীর সূঁচের খোঁচা আছেই, থাকেই। মোটকথা, আমি জীবনের একটা স্টেজে এসে নারীদের উপর এমন ধারণা পোষণ করি যে, যদি ছেলে ও মেয়ে একই মায়ের পেটে না জন্মাতো তবে তারা যে মানুষ- এটা থেকে আমার বিশ্বাস উঠে যেত।
স্কুলে পড়ালেখার সুবাদে আমি পরিচিত হই অনেকগুলো মেয়ের সাথে। যতগুলো মেয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি তাদের কাউকেই আমি আলাদা করতে পারিনি। সবাই একই ক্যাটাগরীর নারী জাতিতে পড়ে। স্কুলে আমি ৩৫ জন মেয়ের সাথে কাটিয়েছি- ক্লাস সিক্সে। পুরো এক বছর। এদের মধ্যে একটা মেয়েকে পেয়েছিলাম যে আমার পুরো ধারণা পালটে দিয়েছিল নারী সমাজের উপর থেকে। তাকে দেখে, তার সাথে মিশে আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি- এ মেয়ে হয়ে পৃথিবীতে জন্মেছে। তার সাথে মিশতে মিশতে এক সময় আমি তার উপর দূর্বল হয়ে পড়ি। এটা আমার কিশোর বয়সের ঘটনা।
আমি যখন কলেজে পড়ি তখনো তার উপর থেকে সে টানটা কমেনি। ইচ্ছা ছিল যদি ভাগ্যে থাকে তো একে বিয়ে করে জীবনসঙ্গী বানাতে কোন সংকোচ করবো না, কোনদিন।
আমাদের এমন কিছু স্মৃতি ছিল যে, কল্পনাও করতে পারিনি কখনো- আমরা দুজনে যদি হাজার আলোকবর্ষ দূরে থাকি তারপরও সে আমাকে ভুলে যাবে, ভুলতে পারবে। এই স্মৃতি গুলির সবই তার বানানো। আমার যতদূর মনে পড়ে- সে একদিন বলেছিল, ও স্বপ্নে দেখেছে এক বুড়ো মানুষের সাথে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অনেক কান্নাকাটি করছে। আর তারপর সে বিয়ের আসর থেকে আমার কাছে পালিয়ে এসেছে। আমাকে খুঁজে না পেয়ে হু হু করে কেঁদে উঠেছে। এত জোরে কেঁদেছে যে, নিজের কান্নার শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এই মানুষটা আমাকে ভুলে গেছে। ভুলে যেতে হয়েছে। এই ভোলার পেছনে আমার কিছুটা দ্বায় আছে। সে আমাকে মনে রেখেছিল, আমি জানি। হলফ করে বলতে পারি। প্রমাণও আছে আমার কাছে। কিন্তু আমরা জানতাম, আমাদের জীবন কখনো এক হবার নয়। আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম এটা সত্য। আর সে জন্যে আমি তার কখনো খারাপ চাইতে পারিনি। আমি হাত বাড়ালে হয়তো সে সমাজ-সংসার ত্যাগ করে চলে আসতো। কিন্তু আমার জন্য তার দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবনটাতে আমার জীবনে দেখা একমাত্র মহীয়সীকে ছোট করতে চাইনি। তাছাড়া আমার বাড়ানোর মত হাত তখন ছিলও না। যদি বাড়ানোর মত হাত থাকতো তবে কোন প্রশ্ন ছাড়াই হাত বাড়িয়ে দিতাম তার দিকে।
যাই হোক, সে এখন সুখী। তার সুখ দেখে আমিও সুখী। তাকে পাইনি ঠিক আছে। সে এখন কেমন জানি না, তাও ঠিক আছে। তার আর আমার জীবনের ইতিও ঘটে গেছে। তার তৈরী করা স্মৃতিগুলো আমার মনে নেই। রাখতেও চাই না আর। শুধু একটা স্মৃতি মনে আছে। ক্লাস এইটে আমার পেটে গ্যাস ফর্ম করেছিল। টিফিনে না খেয়ে খেলে বেড়াতাম তাই। সে জন্য কমপক্ষে এক সপ্তাহ টানা পেট ফাঁকা রাখা যাবে না মর্মে ডাক্তার আমাকে সাত দিনের খাবার রুটিন করে দিয়েছিলেন। টিফিনে মা সবজি দিয়ে রুটি জড়িয়ে দিয়েছিল। খাবার সময় আমি আর ওই মেয়েটা একসাথে ছিলাম। আমি জড়ানো রুটি বের করে খাচ্ছিলাম। ও তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। রুটি দুটো সবজি দিয়ে জড়িয়ে রাখার কারণে একটু কেমন হয়ে গিয়েছিল দেখতে। তাকে আমি ভদ্রতা করে বললাম- আয়, দুজন মিলে খাই। দুইটা আছে। আমি একটার বেশি খেতে পারি না। সে জড়ানো রুটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ওসব খাই না।
ব্যাপারটা আমি ভুলে যেতে চেয়েছি। স্মৃতিটা কেন যেন রয়ে গেছে। মুছেনি। বিলিভ মি, আমি এই ঘটনা দিয়ে তাকে কখনোই মনে রাখতে চাইনি।
আমার জীবনে এর পর আর কোন মহীয়সী আসে নাই। হাজারো রুপবান মেয়েকে দেখেছি কিন্তু কখনো কোন আকর্ষণ বোধ করিনি। কারণ নারী জাতীর উপর তখনো আমার ঘৃণা কাটেনি এতটুকুও। আমি জানতাম, যত রুপের নারী হোক না কেন, তার ভেতরে আমার সেই ঘৃণার বীজটা আছেই। আর আমি তখনো বিশ্বাস করতাম যে- পৃথিবীর একটা নারীই সে, যে আমার জীবনে অল্প সময়ের জন্য এসেছিল। চলেও গেছে। আর কাউকে আমি তার মত কোনদিন খুঁজে পাবো না।
তার সাথে আমার ইতি ঘটার বহুদিন পরে একটা মানুষ পুণরায় আমার জীবনে আসে। সে কেমন জানি না। কোন কারণ ছাড়া আমি তার উপর অদৃশ্য একটা টান অনুভব করি। স্বর্গীয় টান। দূর্বল হয়ে যাই তার উপর। ধীরে ধীরে নয়। এক দেখাতে। প্রথম দেখাতে।
আমার কী থেকে কী হয়েছে জানি না। কোনদিন বলতেও পারবো না। তাকে কেউ আমার সামনে ছোট করলে কেন জানি আমার সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে যায়। তাকে যেন না দেখলে আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাই। এই মেয়ের সামনে পড়লে আমি কেন জানি কথা বলতে পারি না। একশ হাত দূর থেকে তার ছায়া দেখলেও মনে হয়, আমি থেমে আছি আর আসমান-জমিন আমাকে ছেড়ে ঝড়ো গতিতে দিক-বিদিক ছুটে চলেছে।
আমার জীবনটা যদি একটা মালা হয় তবে সেই মালার সূঁতো সে। যে আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসকে মালায় গাঁথা ফুলের মত করে ধরে রেখেছে। আমি কেন জানি 'লিটল বয়' এর মত বিশ্বাস করতাম- এই মানুষটাকে স্রষ্টা যে কোন ভাবে আমার করে দেবে। কীসের ভিত্তিতে বিশ্বাসটা করতাম, জানি না। তার ব্যাপারে আমার এই বিশ্বাস যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে- তখন জানলাম তার বাগদান হয়ে গেছে। আকাশ ভেঙ্গে প্রচণ্ড গতিতে আমার মাথার উপরে পড়তে গিয়ে থেমে গেল, পড়লো না। পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে শুরু করলো। এই মাটি ভাঙ্গেও না, সরেও না। কাঁপতেই থাকলো। আমি ভেঙ্গে পড়লাম। ভেঙ্গে থাকলাম। মনকে অনেক বোঝালাম। যা আমার নয়, তাকে ভুলতে হবে। মন থেকে তাকে কোনভাবেই মুছতে পারলাম না। মন ডুকরাতে লাগলো। গুমরাতে থাকলো। একসময় আমি আকাশের দিকে তাকালাম। তাকিয়েই থাকলাম- 'লিটল বয়' হয়ে।
কয়েক বছর কাটল তাকে আকাশে খুঁজে বেড়াতে। পেলাম না। পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখলাম না। সমাজ-সংসার সব কিছু আমার বিরুদ্ধে। কেউ চায় না আমি তাকে- আকাশের শুন্যে খুঁজি। যাকে চাই, সেও চায় না। জানেও না যে, পাশে বসে থাকা মানুষটি তাকে মহাশুন্যে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
মেয়েদের একটা সিক্সথ সেন্স থাকে। ন্যাচারাল। তারা এই সেন্স ব্যবহার করে কিছু ¯পর্শকাতর বিষয়কে বুঝতে পারে। আমার কাছে আশ্চর্য হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অলৌকিক নয়। মানুষটার সাথে আমি যতদিন কাটিয়েছি তাতে দেখেছি- এ আর দশটা সাধারণ মেয়ের মত সিক্সথ সেন্স সম্বলিত নয়। সে বুঝতে পারে না- কোনটা চিটিং, কোনটা ফটকাবাজি, কোনটা বন্ধুত্ব আর কোনটা প্রেম। স্বর্গীয় অনুভূতি।
আমি এই মানুষটাকে এক সময় পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম। জীবনকে নতুনভাবে সাজাতে লাগলাম। পারলাম না। আমি জানি, তাকে হারানোর এই ক্ষত কোনদিনই সারবার নয়। এই ক্ষতে চিরকাল মাছিতে ডিম দিয়ে যাবে আর তা থেকে লার্ভা জন্মাবে। তারা কিলবিল করবে।
অবশেষে তাকে ছাড়া আমার জীবনকে নতুন একটা অধ্যায়ে পদার্পন করাই। জীবনের যে জগতে আর কেউ থাকবে না। কারো দরকারও নেই। হবেও না। নতুন এই জীবনে আমি তারপর আর কাউকে খুঁজতে চাইনি। খুঁজতে যায়নি।
জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর এই ধাপে গিয়ে আমি এবার একটা ভুল যায়গায় পা ফেলি। আমার এই ভুল জায়গাটাকে চিনতে একটু সময় লাগে। আমার বিশ্বাসের প্রতি আমি বিতৃষ্ণ হয়ে যাই। মাথার উপরে ভেঙ্গে পড়ে থেমে থাকা আকাশটা আরো নিকটে চলে আসে। পায়ের নিচের মাটির ক¤পন আরো বাড়তে থাকে। আমি যেন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীতে পরিণত হই। সোজা হয়ে দাঁড়াতে ভুলে যাই।
তাকে ছাড়া এভাবে অনেক দিন কাটে আমার। আমি 'লিটল বয়' এর মত বিশ্বাস নিয়ে ঝাপসা চোখে মাথার উপরের ভেঙ্গে পড়া আকাশের দিকে শেষ আশা নিয়ে শেষবারের মত আরেকবার তাকাই। দেখি আকাশটা মাথার উপরে নেই। মাটি হঠাত তার ক¤পন থামিয়ে দিয়েছে। ক্ষতের পোকাগুলো কিলবিল করছে। সে কীভাবে যেন আয়েশা হয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে! আমাকে লিও বলে ডাকছে। আমার মেরুদন্ডরে হাড়গুলোর অস্তত্বি অনুভূত হয় বহুদিন পরে।
আমার আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার অদৃশ্য বিশ্বাসটা 'লিটল বয়' এর বিশ্বাসের মত মিলবে কিনা- সেটা আয়েশা জানে। আমার কাছে সে উত্তর নেই। তবে এটুকু বিশ্বাস আছে, আমাকে আর মেরুদন্ডহীন হওয়া লাগবে না। আয়েশা সেরকম নয়।
ফিরে আসা আয়েশা মহীয়সী কিনা- জানি না। জানার দরকারও নেই। তারও মহীয়সী হবার দরকার নেই। তার কস্ট, আমার কস্ট। তার কান্না, আমার নদী। তার সুখ, আমার সুখ। তার চাওয়াটা আমার পাওয়া। তার চোখ, আমার বিশ্বাস। তার অনুভূতি- আমার ভালোলাগা।
আয়েশা আমার জীবনের সূঁতো, যে মালার পুঁথির মত আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস কে গেঁথে রেখেছে। তাকে জীবনের প্রথম যখন দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল- এ মেয়ে কোন মানুষ নয়। মানুষের রূপ ধরে আমার সাথে পড়তে এসেছে। নিশ্চয় পরী! আমার খোদার সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দরতমটি!
No comments:
Post a Comment