আমি আর
কালু। দুইজন এসেছি। একটা গ্রাম বা শহর বা নগরী বলব কিনা বুঝছি না। কিছু একটা হবে।
একটা এলাকা। পদ্মা নদীর একটা বাঁক চলে গেছে এদিক দিয়ে। নদীর উপর একটা ব্রীজ।
ব্রীজের ওপারে গেলেই একটা নতুন নগরী। এই নগরীর মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
এরা অন্য কোন এলাকায় যায় না। কাজ কাম বা রোজগার বা ব্যাবসার উদ্দেশ্যে। বরং এদের
ভিন্নধর্মী জীবনচরিত দেখে বাইরের মানুষ আকৃষ্ট। এদের জীবনযাত্রা দেখে তারাই এদের
এখানে আসে। কারো কোন বড় কাজের দরকার হলে এদের দিয়ে করিয়ে নেয়। যেমন, কোন জেলের যদি
পঞ্চাশটা জালের দরকার হয় তাহলে এখানে চলে আসবে আর এদের বলবে। এরা লোকবল জুগিয়ে
অল্প খরচে সবচেয়ে ভাল করে জাল বুনে দেবে।
এই এলাকার লোকেরা এমন কোন কাজ নেই যে পারে না। নদীর ওপারে নাপিতের কাজ কামার
পারে না। কৃষকের কাজ মুচি পারে না। মেথরের কাজ সাধারণ পাবলিকের কেউ পারে না। আর
পারলেও করে না। অথচ এই এলাকার সবাই সব কাজ পারে। সবাই সব করে। একই লোক জাল বুনে
দিবে আবার তার কাছে কেউ হারমোনিয়াম শিখতে আসলে শিখিয়ে দেবে।
আমি আর কালু পদ্মা পার হবার জন্য নৌকায় চড়লাম। পদ্মায় পানি নেই তেমন। নিচের
বালি দেখা যাচ্ছে। নৌকার মাঝি নদীর এপারের মানুষ। ওপারের কারো নৌকা নেই।
আমি আর কালু দুইজন এখন নদীর ওপারে। মানে সেই রহস্য নগরীতে। এখানের মানুষ গুলো
আমাদের থেকে দেখতে আলাদা। চাইনিজ আর থাই এর মিশ্রণ মনে হচ্ছে। তবে কথা বলছে বাংলা
ভাষায়। অনেক ভদ্র আর মার্জিত।
একটা বিশাল বাড়ি। বাড়ির ভেতরে অনেক বড় উঠান। পঁচিশ জনের মত লোক একসাথে কাজ
করছে। বই বাঁধাইয়ের কাজ। কোন প্রকাশনী তাদের বই এনে এদের থেকে বাঁধাই করে নিয়ে যায়।
এরা অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করে দেয়। লাভ বেশি হয়। আমি আর কালু তাদের কাজের মনোযোগ
খেয়াল করলাম। তারা কেউ ই আগন্তুক আমাদের দিকে চোখ ফিরিয়েও তাকালো না। যার যার কাজ
করছে মনোযোগ দিয়ে।
আমরা দুইজন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। বাইরে ঘুরাঘুরি করছি। অন্যদের দেখছি। এরা
অনেক পরিশ্রমী। আর অনেক ভদ্রও বটে। আমাদের সাথে সবাই খুব ভালো আচরণ করছে । কিছু
জিজ্ঞাসা করলে দারুণভাবে উত্তর দিচ্ছে। কোন বিরক্তি অনুভব করছে না।
সারাদিন ঘুরার পর বিকেল হয়ে গেল। আমি আর কালু নদী পার হয়ে চলে এসেছি। এপারে
একটা রেল স্টেশন আছে। এই এলাকায় আসার জন্য এখানে স্টেশন বসানো হয়েছে। একটাই ট্রেন
আসে সারাদিনে। একবার ভোরবেলায় আর আরেকবার সন্ধ্যা বেলায়। আমরা সন্ধ্যাবেলার ট্রেন
ধরে বাড়ি চলে যাব। সকালের ট্রেনে এসেছিলাম। এপারে এসে মনে পড়ল কী এক জরুরী জিনিস আমি ফেলে এসেছি। ওইপারের কোন এক দোকানে। ট্রেন মিস হলেও জিনিসটা আনতেই হবে। আজকের
ট্রেন মিস হলে দরকার হয় ভোরের ট্রেনে যাব। তাও জিনিসটা ফেলে যাওয়া যাবে না।
আমি আর কালু আবার ফিরলাম সেই নগরীর উদ্দেশ্যে। নদীর সামনে এসে দেখি নদীতে
ব্রিজ নেই। নৌকা নেই। নদীর পানি শুকিয়ে বালি বেরিয়ে গেছে। উপরে বাঁশের আড় দিয়ে
এপার থেকে ওইপারে যাওয়ার রাস্তা করা। নিচে ওইপারের বাচ্চা পোলাপান খেলা করছে। আমি
আর কালু শখ করে আড় বেয়ে নদী পার হলাম। শখের কারণে আড় বেয়ে পার হতে সময় লাগলো অনেক।
নদীর ওইপারে গিয়ে সেই দোকানটায় আমার ফেলে আসা জিনিস টার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। লোকটি
বলল, তারা কারো ফেলে রাখা জিনিষ নিজের কাছে রাখে না। তাদের একটা সংগঠন আছে। সারাদিন
ঘুরে কারো ফেলে রাখা জিনিষ নিয়ে তাদের কাছে রাখে। পরে মালিক আসলে তাকে ফেরত দেয়া
হয়। যত মুল্যবান জিনিস হোক না কেন, হারাবে না। ফেরত পাবেন। আমাকে আশস্ত করল এক দোকানদার।
আমি ঠিকানা নিয়ে পথ ধরে হাটা দিলাম। আমার সাথে কালু।
আমরা ঠিকানায় পৌঁছালাম। একটা বাড়ি। অনেক সুন্দর। ভেতরে গেলাম। বাড়ির ভেতর সবাই
মেয়ে। কোন ছেলে নেই। কাপড় চোপড়ে এদের কোন শালীনতা নেই। আমরা দুইটা ছেলে ঢুকেছি
তাতে তাদের ভ্রুক্ষেপও নেই। যার যার মত ঘুরছে। আমি একটা মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম
আমাকে এই ঠিকানা দেয়া হয়েছে। এখানে আমার একটা ফেলে রাখা জিনিস আছে।
মেয়েটি আমাকে বলল, আপনার জিনিসটা এখানে আর নেই। অন্য যায়গায় চলে গেছে। মেয়েটি
আমাকে আরেকটি বাড়ির ঠিকানা দিল। আমরা বের হয়ে একটা ভ্যান ভাড়া করে সেই বাড়িতে
গেলাম। বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখি একটাই ঘর। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গল্প করছে আর
হাসাহাসি করছে। আমি তাদের আমার হারানো জিনিসটার কথা বলার আগেই ছেলেটা কী যেন নিয়ে
আমার সামনে আসল। আর বলল, এটা আপনার। আমি সেটা হাতে নিলাম। একটা কুকুরের বাচ্চা।
সাদা ফটফটে। খুবই কিউট। আমার কী হারিয়েছে মনে নাই। কুকুরের বাচ্চাটা দেখে সেটা আর
নিতেই ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে কিছু না বলে কুকুরটা নিয়ে চলে যাই। ডানে কালুর দিকে
তাকিয়ে দেখি সে মেয়ে হয়ে গেছে। সালোয়ার কামিজ পরা। আমি খুবই আশ্চর্য হলাম। মেয়েটি
আমাকে বলল, প্রবলেম নেই। এই বাড়ির মধ্যে যারা একবার ঢুকে তারা ছেলে মেয়ে হয়ে যায়।
একজন এই বাড়িতে একা ঢুকতে পারে না। দুইজন ঢুকলে একজন ছেলে আর একজন মেয়ে হয়ে যায়।
আপনারা ইচ্ছা করলে এখন এখানে সারাজীবন থেকে যেতে পারেন। কেউ কোনদিন বুড়ো হবেন না।
আপনাদের বাইরের জগত নিয়ে কোন চিন্তাও করা লাগবে না। আমরা এখানে সাত বছর ধরে আছি। আর
বেশ ভাল আছি। আপনাদের মত আমরাও এসেছিলাম এখানে। তারপর আর যাইনি। এখানে আরো
দুইজন ছিল। ওরা দশ বছরের মত ছিল। আমাদের আগে এসেছিল। পরশুদিন ওরা দুইজন চলে গেছে।
অদের দুনিয়ায়। তাই বাবা আপনাদের পাঠিয়েছে এখানে। আপনারা যদি ইচ্ছা করেন তো থাকতে
পারেন। না করলে চলে যান। ঘরের বাইরে গেলে এখানের সব স্মৃতি ভুলে যাবেন।
কালু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, থেকে যাই। আমি তো মেয়ে হয়েই গেছি। বাইরে গিয়েও যদি
মেয়ে থাকি তখন?
আমি বাইরে গেলে আপনাদের বাবার সাথে দেখা করতে পারবো? এসবের কাহিনির নেপথ্যে
জানতে পারবো?
আপনি বাইরে গেলে সব ভুলে যাবেন। তাই কোন সুযোগ নেই আপনার।
আমি পকেট থেকে নোটবুক বের করে বাবার ঠিকানা লিখে নিলাম। বাইরে গিয়ে কী কী করতে
হবে মেয়েটার কাছে শুনে নিলাম। লিখে নিলাম।
আমার হারানো জিনিসটা কুকুর নয়। ভুল
হয়েছে আপনাদের।
বাইরে গেলেই ওটা আপনার হারানো জিনিসে পরিণত হবে। কুকুরটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখেন।
এই বাড়িতে কোন মৃত বস্তু থাকে না। যা আছে সব জীবিত। বাইরে গেলে অইটা আসল বস্তু হয়ে
যাবে যা আপনি হারিয়েছেন।
আমি আর কালু বাইরে চলে আসলাম। আমরা ভ্যান ভাড়া করে আবার নদীর পাশে এসেছি। পকেট
থেকে ভাড়ার টাকা বের করতে গিয়ে নোটবুকের ছেঁড়া পাতা বের হলো। পাতা পড়ে বুঝলাম
আমাদের কোথায় যেতে হবে। কোথা থেকে কীভাবে এসব লিখেছি তার কিছুই মনে করতে পারলাম না।
ভ্যান ওয়ালাকে ঠিকানা বললাম, সে নিজেই আবার আমাদের আগের সেই মেয়েভরা বাড়িটার সামনে
নামিয়ে দিল। ভেতরে গিয়ে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করার আগেই একটা মেয়ে আমাদের দুইজনকে
ভেতরে নিয়ে গেল।
বাবা কোন ছেলে নয়। বয়স্ক কেউ নয়। একটা পিচ্চি মেয়ে। আমাদের দেখে বলল, আপনাদের
আমি পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু আপনারা ভুল করলেন। আমি কাগজের লিখা পড়ে শুনালাম। তিনি
বললেন সব ঠিক আছে। আপনারা এখন চলে যেতে পারলে চলে যান। আজ রাতে কোন তারা উঠবে না।
যদি সকাল হওয়ার আগে ট্রেন ধরে চলে যেতে পারেন তো গেলেন। আর তারা উঠলে কাল পর্যন্ত
সময় পাবেন। আর না হলে আপনারা দুইজন ই মেয়ে হয়ে যাবেন এবং এই বাড়িতে আপনাদের
সারাজীবন থাকতে হবে। সবাই যেমন আছে এখানে। আপনাদের যেখানে পাঠিয়েছিলাম সেটা পছন্দ করলে ভাল করতেন।
আমি আর কালু বিমর্ষ মুখে বাড়ি থেকে
বের হয়ে এসেছি। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগে। আমরা নদীর পাশে এসে দেখি নদী পানিতে
ভর্তি। কোন নৌকা নেই। বাঁশের আড় নেই। ওপারে স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা
নদীর এপারে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
আকাশের দিকে তাকালাম। সত্যি কোন তারা নেই। কালুর মুখচোখ শুকিয়ে গেছে। ট্রেন
হুইসেল দিচ্ছে। আমরা দুইজন বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। আজকের মত একটা তারা হলেও
যেন উঠে।
রাত প্রায় শেষের পথে। তারাদের কেউ এখনো উঠেনি। আমি তাকিয়ে আছি নদীর কলকলে বয়ে
চলা পানির স্রোতের দিকে। আর কালু আকাশের দিকে। সকাল হওয়ার আগে যেন একটা হলেও তারা
উঠে।
কিছু মানুষের মনের আকাশের বিশালতা নেই। সে আকাশে কখনো উল্কা উড়ে না। চাঁদ-তারার
অস্তিত্ব নেই। তাদের মাথার উপরে সামান্য অঞ্চল মিলে রয়েছে স্থির কালো মেঘ। যা কেবল
কর্কশ শব্দে শুধু ভয় দেখাতে পারে। কখনো তা বৃষ্টি নামিয়ে স্নিগ্ধ সজীবতায় কাউকে
ভেজাতে পারে না। ঘুটঘুটে এই মেঘের নিচে আঁশটে কুয়াশার সান্দ্রতায় এই ভীতুদের বাস।
মাথার উপরের আকাশে তারা নেই তাতে কী? কালুর মনের আকাশে ছায়াপথ আছে। সে হয়তো তার আকাশের তারাদের কখনো গুনে
দেখেনি? জানেও না, তারা সংখ্যায়
কত?
No comments:
Post a Comment