Saturday, January 4, 2020

ফুলপরী


অণিকার ক্লাসে মেঘ তৈরি পড়াচ্ছেন তার বিজ্ঞানের শিক্ষক আফজালুর রহমান। বৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার এক সুমহান উপহার। এটি বর্ষণ হয়ে মাটিকে জীবন দান করে। বর্ষিত এলাকা ভরে উঠে সবুজে। আধমরা গাছপালা নিজেদের ধুয়ে মুছে টকটকে সবুজ রঙয়ে ডাঙ্গর হয়ে উঠে। শুকনো মাটিতে পড়ে থাকা বীজগুলো অঙ্কুরিত হওয়ার উদ্দীপনা পায়। তরুণ সব গাছপালায় এলাকা ভরে উঠে। সবুজ পাতা, নতুন কুঁড়ি, ফুল, ফল আর তারপরে অপর্যাপ্ত নানা রকম শস্যে ভরে উঠে এলাকা। মৌমাছির ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রাণীকুল খাদ্য সন্ধানে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। শস্য থেকে আহার করে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে এসে কিছুটা আবার ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে। এভাবে জীবকুলে ভরে উঠে পুরো এলাকা। পুরো গ্রাম। পুরো দেশ। পুরো পৃথিবী।

অণিকা গালে হাত রেখে কনুইয়ে ভর করে বেঞ্চিতে ঠেস দিয়েছে। তার চোখদুটো এখন ফ্ল্যাটের বেলকনি ও তার আশেপাশের দৃশ্যপট দেখছে। স্যারের কথামত, বাসায় টবে লাগানো পাতাবাহারের গাছে কোন মৌমাছি আসে না। যাবতীয় প্রাণীকুল তাদের বাসার আরো সব রঙ্গিন পাতার গাছগুলো থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে না। তার জানামতে তাদের ফ্ল্যাটে বৃষ্টির পানির ছিটেফোটাও কোনদিন ঢুকেনি। টবগুলোতে তার আম্মু অনেক দিন পরপর মগে করে ট্যাপের পানি ঢেলে দেন। পাতাগুলো দিনরাত চকচকে। শুধুমাত্র অণিকাদের বিল্ডিঙয়ের গার্ড আকরাম কাকুর বিড়াল ছানা বাদে যাবতীয় জীবকুলের ক্ষেত্রে ‘আধমরা’ শব্দটি অণিকার কল্পনার বাইরে।

আফজালুর রহমান ক্লাসের পঞ্চাশ জোড়া উৎসুক চক্ষুকে উপেক্ষা করে মূলকথায় চলে আসলেন। তাহলে আজ আমরা জানব কীভাবে আকাশে মেঘ তৈরি হয়? আর তারপর বৃষ্টি ঝরে?

আফজাল সাহেবের গতিময় ব্যস্ত কণ্ঠকে মাঝপথে থামিয়ে ফ্ল্যাটের আজগুবি গাছগুলোর ব্যাপারে অণিকার স্যারকে জানানো হল না।

ভূ-পৃষ্ঠে আমরা অনেক রকম পানির উৎস দেখি। যেমন- পুকুর, নালা, খাল, বিল, ঝিল, নদী, সমুদ্র, পাহাড়ি ঝরণা আরো কত কী! এই আঁধারে অগণিত পানি অণু খুব শক্তভাবে পরস্পরের হাত ধরে থাকে। এসময় তারা সবাই মিলে তরলাবস্থায় বিরাজ করে। এটিকে আমরা পানি বলি। সূর্যের উত্তাপে পানির উপরিতলের অণুগুলোর মধ্যে হাত ধরা ধরির শক্তি কমতে থাকে। ধীরে ধীরে তাদের বন্ধন দূর্বল হয়ে পড়ে। একসময় লক্ষ কোটি পানি অণু একে অপরকে ছেড়ে পানি থেকে উড়ে বাতাসের সাথে মিশে যায়। এই ঘটনাকে পানির বাষ্পায়ন বলে। আর বাতাসের মধ্যে অদৃশ্য অবস্থায় যে পানি মিশে থাকে তাকে বাষ্প বলে। জলীয় বাষ্প। জলীয় বাষ্পের পানি অণুগুলো বাতাসের সাথে প্রবাহিত হতে থাকে। আর পানি উৎসের উপরিতল থেকে আরো উপরে উঠতে থাকে। এভাবে তারা পুকুর হতে রাস্তায় উঠে আসে। তোমাদের স্কুল ফিল্ডে এসে ভেসে বেড়ায়। বাড়িতে উঠে আসে। ফ্ল্যাটে উঠে। তারপর এক তলা দু তলা করে তিরিশ তলা বাড়ির ছাদে উঠে যায়। আরো উঁচু উঁচু সব বিল্ডিঙয়ের ছাদে উঠে যায়। তারপর তারা সবাই মিলে পাহাড় পর্বতের চূঁড়া লক্ষ করে। আর ভাসতে ভাসতে শেষে পাহাড়ের উপরে উঠে যায়। এরপর তারা আর টপকানোর কাউকে পায় না। বাতাসও আর তাদের নিয়ে উপরে উঠে না। তখন সব পানি অণুগুলো সেই নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে ভেসে বেড়াতে থাকে। ভেসে বেড়ানোর এক পর্যায়ে তারা লক্ষ করে যে, তাদের আশেপাশের খাল, বিল, পুকুর, নদী, সমুদ্র ইত্যাদি থেকে আরো অসংখ্য পানির অণুও তাদের মত সেখানে ছন্নছাড়া হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সবাই সবাইকে এভাবে একজায়গায় দেখে খুব অবাক হয়। তারা বেশ আনন্দের সাথে একে অন্যের হাত ধরতে থাকে। তাদের মধ্যে দুরুত্ত কমতে থাকে আর বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে। অল্প জায়গায় তারা সংখ্যায় অনেক হয়।

স্যার, আমাদের ক্লাস রুমে কি এক কোটি হবে? এরকম?

না, অণিকা। সে সময় বিলিয়ন বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সংখ্যায় থাকে তারা। আমরা গুণে শেষ করতে পারব না। এক কোটি অনেক কম।

এরা এই পর্যায়ে হাত ধরাধরি করে ভাসতে থাকে। আর সবাই মিলে বাতাসে ঘণীভূত হয়। এভাবে তারা সেখানের বাতাসকে সম্পৃক্ত করে। বাতাসের এই সম্পৃক্ততা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অসংখ্য পানি অণুর এই ভাসমান অবস্থা তখন আমরা আকাশে দেখতে পাই। এটি হল মেঘ। তুলনামূলক কম পানি অনু মিলে বাতাসকে ৫০ভাগ সম্পৃক্ত করে, তারা আরো বেশি সংখ্যায় মিলে ৬০ভাগ, তারপর ৭০ভাগ, ৮০, ৯০ এমনকি ৯৯ ভাগ পর্যন্ত সম্পৃক্ত অবস্থায়ও তারা একে অপরের হাত ধরাধরি করে উড়ে বেড়ায়। সম্পৃক্ততার এই পর্যায়ে তারা সংখ্যায়ও অনেক থাকে, তাই পরিমাণে বেশি হয় এবং অনেক ভারী হয়ে যায়।  বাতাসে এই অবস্থাতেও তারা ভেসে থাকতে পারে। পানি অণুগুলো বাতাসকে ৯৯ভাগ সম্পৃক্ত করার পর যে নতুন অণুগুলোর সাথে মিশে না তা নয়। তখনো তারা নতুন নতুন বন্ধু বানাতে থাকে। একে অপরের হাত ধরাধরি করে বাতাসের সম্পৃক্ততা আরো বাড়াতে থাকে। শেষে তারা বাতাসকে ১০০ভাগ সম্পৃক্ত করে ফেলে। এক পর্যায়ে পানি অণুগুলো বড় বড় কণায় পরিণত হয়। আর সবাই মিলে অনেক ভারী হয়ে যায়। একজোট হওয়া পানি অণুগুলোকে এই অবস্থায় বাতাস আর ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে না। পানির ফোটাগুলো তখন বাতাস থেকে অভিকর্ষের টানে ভূপৃষ্ঠের দিকে ঝড়ো গতিতে নামতে থাকে। লক্ষ কোটি পানির ফোটা সবাই যখন একসাথে নিচের দিকে ঝরতে থাকে তখন তারা সবাই মিলে নেচে নেচে গান গাইতে থাকে। তারা পাহাড়ের চূঁড়া হয়ে, তোমাদের ফ্ল্যাটের বিল্ডিঙয়ের ছাদ হয়ে তারপর তিরিশ তলা, ঊনতিরিশ তলা, আঠাশ তলা হয়ে পানির ফোটাগুলো নেচে গেয়ে মহানন্দে পরের তলায় ঝড়োবেগে নেমে আসতে থাকে। কোটি কোটি এই পানির ফোটাগুলোর অসংখ্য রকম গানের সুর যখন একসাথে আমাদের কানে আসে তখন আমরা ‘শঁ শঁ’ আওয়াজ শুনি।

শহরের নামকরা মডেল স্কুলের ক্লাস সেভেনের বিজ্ঞান ক্লাসে আফজাল সাহেবের বানানো এই পানির লক্ষ কোটি নাচুনে ফোটাগুলো অণিকাদের কল্পনার ঝাপসা চোখে এখন আকাশ থেকে নেমে ‘এলবি চৌধুরি ম্যানশন’ বিল্ডিংয়ের তিরিশ তলা হয়ে ঋতুদের ফ্ল্যাটের চৌদ্দ তলার উপরের পনের তলার মাঝামাঝি এসে হুট করে থেমে গেল।

আকাশে কালো মেঘ দেখে ঋতুর মামনি লুতফুন্নেছা খান অনেক আগে টের পেয়েছেন বৃষ্টি নামব নামব করছে। তিনি অফিস থেকে লান্সের পনের মিনিট আগেই বের হয়ে এসেছেন। ঋতু স্কুল শেষে বাসায় গেল কিনা সে ব্যাপারে লুতফুন্নেছার কোন মাথব্যাথা নেই। ড্রাইভার অন্যসব দিনের মত এতক্ষণে ঋতুকে বাসায় নিয়ে গেছে- তিনি তা ভাল করে জানেন। তাঁর চিন্তার মূল কারনটা হল- ঋতুর ঠাণ্ডা এলার্জি। বাচ্চা মেয়েটা একটু হাঁচি-কাশি শুরু করলে খান সাহেব সহ লুতফুন্নেছার হেনস্তার শেষ থাকে না।

খান সাহেবের মেয়ের যত্ন নিয়ে টেনশন নেই। মেয়ের দেখভাল তিনি তেমন করেন না। কাছে আসলে মামনি বলে চুমু দিয়ে দেন। মন ভাল না থাকলে “কলির সাথে খেলগা” বলে তাড়িয়ে দেন। ঋতুর যত্নের যাবতীয় তার মাকেই নিতে হয়।
আকাশে মেঘ চোখে পড়ার পর থেকে লুতফুন্নেছার মাথায় কয়েকটি শব্দ ভয়ার্ত রুপে ঘুরঘুর করছে। ঋতু, কলি, বৃষ্টি, বেলকনি, ঠাণ্ডা এলার্জি, হাঁচি-কাশি, অসতর্কতা, লুতফুন্নেছা, জনমের হয়রানি। তাঁর ব্রেইন শব্দগুলোকে আগপিছ করে ক্রমাগত আধোঃভৌতিক ধরনের নানা রকম সব জটিল বাক্য গঠন করে চলেছে। নতুন পানিতে ভিজলে সর্দি জর থেকে হাতির সাইজ মানুষেরও মুক্তি নাই, ঋতু তো ঋতু। এমন ধরণের একটা সরল বাক্য মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে ফুটপাথ হয়ে লুতফুন্নেছা দ্রুতপায়ে হেটে চলেছেন। আকাশে মেঘের ঘনঘটায় তাঁর উত্তেজনার শেষ নেই। লুতফুন্নেছার পায়ের তাগাদাকে বাংলায় অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়াবে, তাঁর বৃষ্টির আগে বাড়ি পৌঁছানো না হলে ঋতু পানিতে ভিজতে চৌদ্দ তলা থেকে কলিকে নিয়ে ফ্ল্যাটের বেলকনি হয়ে রাস্তার গলিতে লাফিয়ে পড়বে।

মেঘের তড়িঘড়ি দেখে, নিজের পায়ের দ্রুততায় আস্থা হারিয়ে ফেললেন লুতফুন্নেছা। পার্স থেকে মোবাইল বের করে খান সাহেবকে ফোন করলেন।

আলম তুমি কোথায়?

আলম সাহেব বেশ ভারি গলায় উত্তর করলেন, ফ্ল্যাটে।
বৃষ্টি নামছে, তুমি তাড়াতাড়ি ঋতুকে কলির থেকে সরিয়ে নিয়ে শাওয়ার দিয়ে দাও। কোনভাবেই যেন ও বৃষ্টিতে ভিজতে না পারে। ওকে বুঝতে দিও না বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। পরে কান্নাকাটি লাগাবে। আমি জ্যামে পড়েছি, আসতে দেরি হবে। প্লিজ আলম।

আলম সাহেব মেঘ বৃষ্টির সাথে ঋতুর মায়ের এমন উত্তেজনার কোন সঙ্গতি পেলেন না। অদ্ভুত কারণে তিনি কথাও বাড়ালেন না। টেলিফোন রেখে যান্ত্রিক ভঙ্গিতে বেলকনি থেকে ঋতুকে ধরে এনে কোন কথাবার্তা ছাড়াই সরাসরি শাওয়ারে বসালেন।

মামনি, আজকে হট শাওয়ার দেব?
জি আব্বু, কিন্তু সাবান মাখিয়ে দিও না। আমার চোখ জলে।

লুতফুন্নেছা আকাশের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন আর দ্রুতপায়ে হেটে চলেছেন। তাঁর পায়ের গতি মেঘের তড়িঘড়ির সাথে আরো দ্রুততর হচ্ছে। লুতফুন্নেছা ফ্ল্যাটের বিল্ডিঙয়ের গলিতে প্রায় ঢুকে গেছেন। এখন বিল্ডিং থেকে পঞ্চাশ গজের মত দুরুত্তে আছেন তিনি।

তাঁর ফ্ল্যাট সোজাসুজি ঠিক উপর থেকে নিচে একটা মেয়ে দুই হাতে আধমরা লম্বা ডালওয়ালা পাঁচটি করে গোলাপের কলি নিয়ে খালি পায়ে ফুটপাথের মাটিতে লুটিয়ে বসে আছে। সকাল থেকে সে মেইন রোডে জ্যামের সময় পাজেরোর সাহেবদের কাছে ঘুরে ঘুরে প্রায় চল্লিশটি গোলাপ সহ কিছু রজনীগন্ধার স্টিক বিক্রি করেছে। এখন বাঁকিগুলো নিয়ে গলিতে বড় বিল্ডিঙয়ের নিচে বসেছে। এসময় ম্যাডামদের বাবুরা স্কুল থেকে এসে ফুল কেনার জন্য কান্না করে। অল্প দামে দিলে ম্যাডামরা কথা না বাড়িয়ে বাচ্চাদের কান্না থামাতে চট করে দুই একটা করে কিনে নেন।

বিল্ডিঙয়ের নিচে মেয়েটার ফুল বিক্রি আজ প্রথম নয়। পুরো মহল্লায় তার ফুল বিক্রির সুখ্যাতি আছে। পাড়ার সবাই তাকে ফুলপরী ডাকে। মেয়েটির গায়ের বর্ণ কালো হলেও পাজেরোর সাহেবদেরও তাকে ফুলপরি ডাকতে দ্বিধা হয় না। সকালে যখন কোলে করে ফুলের ঝুড়ি নিয়ে মাথায় প্রজাপতি বসানো গোলাপি রঙয়ের ব্যান্ড পরে রাস্তায় বের হয়, ফুলঝুড়ি হাতে এই মেয়েকে তখন ‘পরী’ ছাড়া আর কিছু বলার মানানসই শব্দ আকস্মিক কারোর মাথায় আসে না।

ফুটপাথে লুটিয়ে বসে থাকা এই ফুলপরীর আনুমানিক বয়স বছর আষ্টেক হবে। হয়তো বয়ঃসন্ধিতে পা ফেলার ঠিক আগ মুহূর্তে সে।

লুতফুন্নেছাকে ফুল কেনার জন্য অনুরোধ করতে ফুলপরী ঘাড় উঁচু করল। একইসাথে মেঘের দিকে লুতফুন্নেছাও দৃষ্টিপাত করলেন। তাঁর মনে হল, ক্লান্ত চোখে তিনি বিল্ডিঙয়ের সাত তলার উপরে কিছু দেখতে পান নি।

লুতফুন্নেছার দৃষ্টি থেকে ফুলপরীরটা অনেকখানি উপরে গেল। সে দেখল দলে দলে বৃষ্টির ফোটা ঝাঁক বেঁধে ঝড়ো গতিতে তার দিকে নেমে আসছে।

আলম সাহেব ইতোমধ্যে গরম পানির ঝর্ণার সুইচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পানি শাওয়ারের পাইপের ভেতর ঘড়ঘড় শব্দে গতিশিল হয়েছে।

ঠিক এই মুহূর্তে অণিকাদের ক্লাসে আফজাল স্যারের বানানো বৃষ্টির ফোটাগুলো আবার চলতে শুরু করেছে। ঝড়োবেগে নিচে নামছে। ঋতুদের হট শাওয়ারের পানি পাইপের মাথায় পৌঁছার আগেই বৃষ্টির ফোটাগুলি তাদের চৌদ্দতলার ফ্ল্যাট অতিক্রম করে নিচে নেমে গেছে।

ফুলপরী এতক্ষণে রাস্তার মাঝখানে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফুল সহ তার দুই হাত ১৮০ ডিগ্রি কোণে দুইদিকে ছড়িয়ে ধরেছে। বৃষ্টি ফোটার দল এখন পঞ্চম তলায়। ফুলপরী দুইদিকে প্রসারিত হাত দুটো সোজাসুজি রেখেই আনুমানিক সত্তর সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধ্যের একটি বৃত্ত  তৈরি করে ঘুরতে থাকল।

মডেল স্কুলের ক্লাস সেভেনে তৈরি বৃষ্টি ফোটাগুলো আট বছর বয়সী ফুলপরীর উপরে ঝপাঝপ ঢেলে পড়ল। একইসাথে ফুলপরীর মাথার উপরে চৌদ্দতলার ঋতুকে ভিজিয়ে দিল হট শাওয়ারের ঝর্ণার পানি।

লুতফুন্নেছা পার্স ধরে কোন রকমে নতুন পানির ঝাপটা থেকে মাথা বাঁচালেন। দৌড়ে গিয়ে শেল্টারের নিচে দাঁড়ালেন। “আহ, বাঁচলাম” বলে এক সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

চৌদ্দতলায় ঋতু মনে মনে বৃষ্টি ভেজা একটা কদম ফুলের ছবি আঁকানোর জন্য পেন্সিল বক্স থেকে রঙ বাছাই করছে। আগামীকাল স্কুলে আর্ট ম্যাডামের হোমওয়ার্ক আছে। আলম সাহেব হট শাওয়ারের নিচে পানির কলের সুইচ আনমনে উল্টা প্যাঁচে ঘুরাতে চেষ্টারত মেয়েকে এক ভবিষ্যৎ লেডি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন। তবে লুতফুন্নেছা অবশ্যই ডাক্তার প্রিফার করেন। ঋতু পেটে থাকতেই তিনি ডাক্তারি বিদ্যার নানা বই বাজার থেকে কিনে এনে শব্দ করে পড়তেন।

ক্লাসে অণিকার মনে মেঘ বৃষ্টি গাছপালা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানে স্যারকে কিছু বলার সুযোগ হচ্ছে না। বাসায় গিয়ে সব প্রাইভেট টিচারকে এক এক করে জিজ্ঞাসা করবে।

ঋতুদের গলিতে বৃষ্টি থামেনি। ফুলপরী এখনো ঘুরেই যাচ্ছে। তাকে নিয়ে কারো আশা নেই। তারও কোন প্রশ্ন নেই। হাতের ফুলগুলো ভিজে চুপসে গেলেও কেউ মাথা উঁচু করেনি। তাদের সবাই জানে, বিক্রি হওয়া বন্ধু গুলোর কেউই সাহেবদের প্রেয়সির হাতে পৌঁছায়নি, পৌঁছায় না। ড্রাইভারের পাশের সিটে চিরকাল অযত্নে অবহেলায় মর্মর হয়ে পড়ে থাকে স্বপ্নহীণ তারা।

1 comment: