বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি। খুলনা যাবো। এক
পরিচিত আপুর বিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে আপুর সাথে সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। কিছুদিন রুমমেটও
ছিলাম। বিয়ের দাওয়াতটা এমন যে, যেতেই হবে। দুনিয়াতে যদি কেয়ামতের
আল্টিমেটাম হয়, সূর্য যথারীতী সকালে পশ্চিমে উঠে পূর্বে
ভেসে যাচ্ছে এরকমও হয়- তবুও আজকের ডেটে আমাকে যেতে হবে। দাবীটা আপুর নয়। আন্টির।
আমার উপর কী কারণে আন্টির এমন দাবী, অনুমেয় নয়।
আমার হাতে একটা ছোটখাটো ট্রাভেল ব্যাগ।
আগামীকাল বিয়ে। শনিবারে ফিরবো। বেশি কিছু নেয়ার প্রয়োজন নেই। বিয়ে বাড়িতে সাজুগুজু
করার জন্য একটা মেকাপ বক্স আর পরার জন্য একটা শাড়ী নিয়েছি। সাথে দুই সেট সালোয়ার
কামিজ। হাফ লিটারের সেভেন আপের বোতলে এক বোতল পানি আর এক হালি কলা। কেনা পানি আমি
খেতে পারি না। ফিল্টার পানি তেতো লাগে। বমি ভাব আসে। পেট ঘেটে উঠে। ৭-৮ ঘন্টার
রাস্তায় শুধু হাফ লিটার পানি আর চারটে কলাতে সামাল দিতে পারবো না। বাস থেকে নেমে
আরো কতদুর যেতে হবে কে জানে?
পাউরুটি কেনার জন্য রাস্তার অপর পাশের এক
খুপরি দোকানে গেলাম। ভালো মানের পাউরুটি নেই। দুইটা ছোট ছোট রুটি আছে তাও গতকাল
এক্সপায়ার ডেট শেষ হয়ে গেছে। দেখতে খারাপ লাগছে না। এক্সপায়ার ডেট দেখিনি এমন
ভঙ্গি করে খেয়ে নিলে সমস্যা হবেনা। এই বাস স্টপে আর কোন দোকান খোলা নেই। কেন খোলা
নেই কে জানে। রেল স্টেশন-বাস স্টপ এসবের আশেপাশের দোকানগুলো ২৪/৭ সার্ভিস দেয়। অথচ
এখন সব গুলোই বন্ধ। শুধু আকবর হোটেল খোলা। ভাতের হোটেল। ভ্রাম্যমাণ মানুষগুলি এই
হোটেলে চড়া দামে ভাত খায়।
মাথার উপরে কটকটে রোদ। পিচঢালা রাস্তায়
রাজ্যের গরম। বড় বড় ট্রাভেল ব্যাগ হাতে বাসের অপেক্ষায় অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
হাইফাই জামাকাপড় পরা। সাহেব বাবু চেহারা বেশিরভাগের। ভাতের হোটেলের ভেতর থেকে চড়া
দামে ভাত খেয়ে বের হচ্ছে অগণীত মানুষ। ঘুরে বেড়াচ্ছে টিকেট কালোবাজারি করা সব টাউট
বাটপার। বড় বড় বাস এখানে এসে ব্রেক কষছে। জানালা দিয়ে বাচ্চারা, মহিলারা
বাসের পেট্রোলের গন্ধে বমি করছে। মাথার উপরের সূর্য তার ইচ্ছামত রাস্তায় তাপ ঢেলে
চলেছে। রাস্তাও সমান তালে সে তাপের বিকিরণ করছে। বাসগুলি ভদ্রলোকদের কিছু নামিয়ে
দিচ্ছে, কিছু তুলে নিয়ে হুশ করে টান দিয়ে আবার বেরিয়ে
যাচ্ছে। রাস্তা ক্লিয়ার করছে।
-আফা, দুইডা টেকা দেন। গরীব মানুষ।
সাত থেকে দশ বছরের বাচ্চা হবে। গোলগাল
চেহারা। গলার স্বরে ভারত্ব আসা শুরু করেছে। আমার দিকে হাত টান করে এগিয়ে ধরে আছে।
পা দুটো হাটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা। দু’হাত মুঠো করে তাতে ভর দিয়ে ছেঁচড়িয়ে
ছেঁচড়িয়ে আসলো। দু’হাতের কনুই থেঁতলে আছে। চোখমুখে ধুলা জমে ঘামে ভিজে কাদাকাদা
অবস্থা।
আমি পার্স থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের
করে দিলাম।
-আফা নেন।
-কী নিব?
-টেকা ফেরত নেন। আমি তো
দুই টেকা চাইলাম। আফনে পাঁচ টেকা দিলেন, তাইলে তিন টেকা
ফেরত পাবেন।
একটু পর এই স্টপে আমি থাকবো না। দাঁড়িয়ে
থাকা ভদ্রলোকদের কেউ থাকবে না। থাকবে শুধু টাউট-বাটপার, রাস্তায়
ছিটিয়ে পড়া কাঁচা বমি। আর উত্তপ্ত রাস্তার উপর ছেঁচড়িয়ে চলা অবহেলিত এই মানুষগুলো।
সাথে তাদের হাতে গুঁজে দেয়া আমাদের বিরক্ত মুখের ভালোবাসা। গতিময় এই ভদ্র সমাজে
প্রাপ্য তিন টাকা ফেরত নিতে, এখন দশ বছর বয়সী এক
ভিক্ষুকের কাছে আমাকে হাত পাতা লাগবে। আমি এদিক ওদিক খেয়াল করলাম, কেউ আমাকে দেখছে না। শুধু আমরা একে অপরকে দেখছি।
আমি চিন্তিত চোখে আর ছেলেটা হিসেবে ভুল করেছে এমন ভঙ্গিতে!
No comments:
Post a Comment