একদম ভরদুপুর। ১.৩০
এর কিছু বেশি হবে। ১৭ই জুন। দুপুরের রোদের তীব্রতার মত পেটের চেঁচামেচিও তীব্রতর। সকাল
৭.৩০ এ খেয়েছি। হারুন ভাইয়ের ক্যান্টিনে।
হারুন ভাইয়ের ক্যান্টিনের
সকাল বেলা খাওয়া এক প্লেট ভাত, আলু ভর্তা আর ঝোল
ডাল আমার পেটে এতক্ষণে মল হয়ে গেছে। সকালে,
প্লেটে
হেলাল পিরিচে করে ভাত ছিটিয়ে আবার পিরিচ দিয়ে হালকা করে প্লেটের চারদিক থেকে ভাত ঝেড়ে
দিচ্ছে। কোণায় এবড়ো-থেবড়ো ভাবে ভাত ছিটে থাকলে প্লেটের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়, কাস্টমার পছন্দ করে না- হেলালের যুক্তি। হারুন
ভাই অবশ্য বললেন- হইচে, আর ফেলিস না, ভাই ভাত একটু বেশি খায়।
পাতিলের ডাল ঢেলে
ভর্তা মাখিয়ে ভাতটুকু কোনমতে খেয়ে তড়িঘড়ি করে বের হলাম। আজকের ডালটা ভালোই ঘন হয়েছে।
আলুর দাম কমেছে হয়তো।
সকাল ৮.১৫তে আমার
ক্লাশ শুরু। দেরি হয়ে গেলে হাজিরা মিস হয়ে যাবে। স্যার খুব কড়া। ক্লাশে বসে কোনভাবে
‘ইয়েস স্যার’ বলতে মিস হয়ে গেলেও আর হাজিরা পাওয়া যায় না। নাম ডাকা শুরু হলে কয়েক জনের
পর আমার নাম এসে যায়। তাই হাজিরা নেয়ার জন্য হলেও স্যারের ক্লাশে টাইম মত আসতে হয়, টাইম মত ‘ইয়েস স্যার’ বলতে হয়। স্যারের কোনদিন
ক্লাশে আসতে দেরি হয়েছে- এমন অভিযোগ কোন সিনিয়র ভাইয়ের মুখেও শুনিনি। ভাল করে খোঁজ
নিলে দেখা যাবে তাঁর সাম্রাজ্যে বিশাল অশান্তি। রাতে ঘুমানোর আগে স্যার আয়তুল কুরসী
না পড়ে ভাবেন, কখন যে মধুর বউয়ের
মোরগটা কক কক করে!
আমাকে সময় মত ক্লাশে
পৌঁছতে হবে। আমার রোল নম্বর প্রথমদিকে।
টানা তিনটা ক্লাশ
হলো। তিনটা হাজিরা দিলাম। দুইবার ‘ইয়েস স্যার’ আর একবার ‘ইয়েস ম্যাডাম’ বললাম। শেষের
ক্লাশটা শুকনো মুখে কাটলো। কত কষ্টে যে দেড়টা বাজলো আয়না পেলে মুখ দেখে বলতে পারতাম।
সকাল থেকে ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম দুইবার। সেখানে আয়না নেই। কবে থেকে যে নেই সেটাও জানি
না। ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার পরে কোনদিনই দেখিনি।
গত বছর আমাদের ডিপার্টমেন্টের
এলামনাই হলো। সব পুরাতন ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছিল। আমি ওয়াশরুমে। কারেন্ট নাই, ভেতরটা অন্ধকার। ভারী বয়সের কয়টা লোক এসে ভীড়
জমালো। বেশ ভদ্রভাবে তারা এক নম্বর,
দু
নম্বর সারছে। কোন হৈ চৈ নেই। বয়সের সাথে ভদ্রতা বেড়েছে। আমরা বন্ধুরা একসাথে টয়লেটে
এসে এমন ভদ্রতা দেখানো বেশ কঠিন। একসাথে কয়েকজন এলে কারো ভেতরেরটায় ঢোকার সাহস হয় না।
উপর থেকে কেউ না কেউ উঁকি দিবে। দেয়াল বেয়ে উঠতে না পারলে বাইরে থেকে পানি ছিটিয়ে দিবে।
সেলফি স্টিক দিয়ে মোবাইল উঁচিয়ে ছবি তুলবে। ভেতরেরটা একটু বাদর টাইপ হলে পোজ দিবে, ভঙ্গি করবে।
এনারা এমন নন। হালকা
অন্ধকারে সবাই চুপচাপ। শুধু টয়লেটের ভেতর থেকে ট্যাপে পানি ছাড়ার সঁ সঁ শব্দ আসছে।
শব্দটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথে ভেতরের জন চেঁচিয়ে উঠল- আরে দোস্ত! বদনা
তো ওইটাই আছে!
খিদেয় পেট চোঁ চোঁ
করছে। সায়েন্স বিল্ডিং এর দুইটা গেইট এর যে কোন একটি দিয়ে বের হলেই রিক্সার সারি। গেটের
সামনে রিক্সাওয়ালারা রিক্সা নিয়ে সারি করে দাঁড়িয়ে থাকে। ছাত্র-শিক্ষক যে কেউ ব্যাগ
হাতে বের হলে সবাই মিলে রিক্সা টেনে সামনে এসে দাঁড়ায়।
কোতি যাবেন? কোতি যাবেন?
আমি বের হলাম। সারিতে
৩টা রিক্সা ছিল। কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। আমি কোথাও যাবো কিনা- জিজ্ঞাসা করা
তো দুরের কথা। একটা রিক্সা মেয়েদের হল থেকে এসে একটা মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে সারিতে দাঁড়ালো।
এই রিক্সাটা- আমার গেট থেকে বের হয়ে চেঁচানো রোদে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ। আমি সিড়ি দিয়ে
রাস্তায় নামছি, সাথে সাথে ড্রাইভার
সাহেব রিক্সার সামনের চাকা আমার দু'পায়ের মাঝে ঢুকিয়ে
দিয়ে ব্রেক কষলো। গতি কম ছিল বিধায় রিক্সা থেমে গেছে। তেমন খারাপ কিছু ঘটল না। মেয়েটা
বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- একটু দেখে-শুনে চালান মামা। আরেকটু হলে তো ভাইয়াটার
সর্বনাশ হয়ে যেত।
মেয়েটির মামা বলল, দেখছেন না আফা! কইষা বেরেক দিচি। এক ইঞ্চিও আগাবার
সাধ্য নাই চাকার। গতকাইল মালিক নতুন বেরেক লাগা দিচে। কাইল কইষা বেরেক করছিলাম অই গেটে, বেরেক শো ছিঁইড়া চইল্লা গেল। পুরানা হইয়া গেছিল
বহুত। মালিকেক ঝাড়ি দিচি আর খরচ দিয়া দিচে। ওই দেখেন, ফুলের গাচটা ভাঙা। ওইডা আমার রিক্সা ঢুকায়া ভাংচি
কাইল।
রিক্সা চালকের কথা
শুনে, আমি তাকায় আছি ভাঙ্গা গাছের
দিকে আর মেয়েটা আমার দিকে।
মেয়েটা আর কথা না
বাড়িয়ে পার্স থেকে টাকা বের করে ভাড়া দিয়ে চলে গেল।
আমার দিকে অল্পবয়স্ক
এক রিক্সাওয়ালা তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
মাইরা
দিলে সর্বনাশ তো ভাইয়ার না, সর্বনাশ ভাবির হইতো।
আফায় বুঝে নাই।
আমি বাদে ওরা চারজনই
হাসলো। তাদের একদফা হাসি শেষে ব্যাপারটা খুবই মজার ছিল বোঝানোর জন্য আমিও মৃদু দাঁত
কেলিয়ে দিলাম। যেন, তাদের কৌতুক বুঝতে
আমার একটু সময় লেগেছে তাই। একজন তো বলেই বসলো, মামা বুজে নাই। হা হা হা হা...
কালাম ভাইয়ের দোকান
এখন প্রথম ভরসা পেটের চিল্লাচিল্লি থামানোর। যে গেইট দিয়ে বের হয়েছি সেখান থেকে কালাম
ভাইয়ের দোকানই সবচেয়ে কাছে। বিশ কদমের মত হবে। অন্য কোথাও যাবার চেয়ে এখানে গিয়ে চারটে
ভাত পেটে দেয়া সবচে উত্তম। আবার ২.৩০ থেকে প্রাক্টিকেল ক্লাশ শুরু। ২.১০ টাইম ছিল।
কিন্তু ক্লাশ ক্যাপ্টেন স্যারকে বলে ২০ মিনিট পিছিয়ে নিয়েছে। গোসলের টাইম নেই। তবে
আরাম করে খাওয়ার টাইমটা পাওয়া গেছে। যারা বিড়ি-সিগ্রেট খায় তাদের জন্য এক্সট্রা সুবিধে
হয়েছে। এককাপ চা গিলতে পারবে। বেশ আরামে পারবে।
আমি কালাম ভাইয়ের
খাবার দোকানে বসে আছি। বেঞ্চে। এখানে এসে দুইজন পরিচিত লোক পেলাম। আমার মত এরাও পেটের
জ্বালা মেটাতে এসেছে। একজন বন্ধু,
আরেকজন
সিনিয়র এক ভাই। দুইজনই খাওয়া শুরু করেছে। আমার জন্য কালাম ভাই প্লেটে ভাত তুলছে। বলছে-
ভাই, মুরগী না মাচ?
যেটার ঝোল স্বাদ
হয়েছে সেটা দেন।
মুরগী খান। আইজ দারুণ
হইচে মুরগীর ঝোল। আমি নিজে খাইচি ভাই।
দেন।
আমি, আমার বন্ধু আর বড় ভাই তিনজন এক বেঞ্চে একই দিকে
ঘুরে বসেছি। আমাদের সামনের দিকে পরের বিল্ডিংয়ের গা ঘেঁষে চারজন বসেছে। আমাদের থেকে
ওদের দূরুত্বটা বলা যায় খুব বেশি দূরে নয় আবার কাছেও নয়। ওরা খাচ্ছে, হাসি ঠাট্টা করছে। ওদের সব কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি।
দু'জন ছেলে আর দু'জন মেয়ে। আমরা ওদের মুখোমুখি পজিশনে। ওদের মধ্যে
একটা মেয়ে এতক্ষণ অন্য দিক ঘুরে খাচ্ছিল। মেয়েটাকে দেখতে পাইনি আমরা তিনজনই। মেয়েটি
আমাদের দিকে ঘুরে বসা মাত্র তিনজন একসাথে চমকে গেলাম। ভাতের লোকমা মুখের কাছে ধরে আপনমনে
বলে উঠলাম- ওয়াও। সিনিয়র ভাইটি আমাদের সাথে মোটামুটি ফ্রী। তিনিও ওয়াও বললেন আমাদের
সাথে। শুরু হয়ে গেল খোঁচা মারা। বড় ভাই বললেন, মেয়েটা আমার। তোমরা চোখ দিও না। আমার বন্ধু বলল- হ, ভাই,
আপনে
নিজের মেয়ের মত দেখেন। আপনি তো আর আমার আপন ভাই না। আমি বললাম, ওর জন্যই আমার জন্ম। ও আমি ভিন্ন আর কারো নয়; হতে পারে না।
কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে
গেল কে নিবে মেয়েটাকে। অন্তত খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত নিজ দখলে থাকুক। আমাদের তর্কাতর্কির
এক পর্যায়ে বড় ভাই বললেন- আরে মিয়া,
ওইখানে
দেখো, দুইটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে।
বুঝছো না। আমাদের বেইল নাই। আগে থেকে বেদখল হয়ে আছে। আরাম করে ভাত খাও। বেদখল জিনিসের
লাইগা গলায় ভাত বাধায়ে মইরো না।
ওরা যেভাবে গল্প
করছে তাতে ওদের বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। কালাম ভাইয়ের দোকানে এদের আগে কখনো দেখিনি। খাওয়া
সূত্রে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে,
মুখ
চেনাচিনি হয়েছে। এরা হয়তো বিবিএ ডিপার্টমেন্টের পোলাপান হবে। পোশাক-আশাক বেশ ভংচং আর
স্মার্ট। এরা টুকিটাকি’র ঐদিকের হোটেলগুলোতে খায়। সায়েন্স বিল্ডিংয়ের এদিকে এদের আনাগোনা
কম।
ওরা চারজন ভাত খাচ্ছে।
মুরগীর মাংস নিয়েছে। হয়তো কালাম ভাই-ই দিয়েছে। নতুন মানুষ, মান বাঁচানোর জন্য যেটা রান্না ভাল হয়েছে সেটা
দিয়েছে। যেন খেয়ে নাম করে। পরের দিন বন্ধুদের ডেকে নিয়ে আসে। কালাম ভাইয়ের বিক্রি বাড়ে।
কালাম ভাই আমাদের
ভালো খাওয়ালেও যা, খারাপ খাওয়ালেও তা।
টুকিটাকির ওইদিকে দুপুর দেড়টার সময় খাবারের স্বাদের জন্য তার দোকান ছেড়ে পায়ে হেটে
কয়জন অতদুর খেতে যাবে? তাই আমাদের সাথে
তরকারীর স্বাদ নিয়ে কালাম ভাইয়ের মাথা ব্যাথা নাই।
একদিন আমি সকালে
খিঁচুড়ি খেতে বসেছি। কালাম ভাই বলল,
ভাই
কয়দিন হলো কালোজিরা ভর্তা করছি। আপনে সকালে খান না তাই পান না। আজ খান। খুব নাম করেছে
আমার ভর্তা। আমি ভর্তা মুখে নিয়ে বললাম- বাহ,
খুবই
স্বাদ হইচে ভাই। পাশের একজন আবার বলল- কই,
আমাকেও
দেন দেখি। এই লোকটা কালাম ভাইয়ের গ্রামের লোক। আমাদের বিল্ডিংয়ে কাজ করে। পিয়ন। নিজের
গ্রামের লোক বলে কালাম ভাই তাকে কালিজিরা ভর্তা দিল না। ছাত্ররা খাবে, নাম করবে। তাকে ভর্তা খাইয়ে কালাম ভাইয়ের লস
ছাড়া কিছু নয়। খিঁচুড়ি যে খাচ্ছে তাও বাকি। বেতন পেলে মাস শেষে হিসেব করে রাউন্ড ফিগারে
টাকা দিবে। ৪৪০ টাকা হলে ৪০০ টাকা। ৪৮০ টাকা হলে ৪৫০ টাকা। এই দশ-বিশ টাকার জন্য বাকির
টাকাটা রাউন্ড ফিগারে আসেনি বিগত সাত বছরের কোন মাসে। এজন্য কালাম ভাইয়ের বড়ই আফসোস।
কিছুক্ষণ পর চামচে
করে কালাম ভাই লোকটাকে সামান্য ভর্তা এনে দিল। লোকটা খেয়ে বলল, ভর্তায় রসুন বেটে দিও কালাম। আরো স্বাদ পাবে
পোলাপান।
আরো স্বাদ দিয়া কী
হবে?
তুমার দুকানের নাম
হবে। কালামের দুকানে সব খাবে ছালপাল। বিক্রি বাড়বে।
কালামের এমনি বহু
নাম। রসুন পিঁয়াজ না দিলেও ছালপাল এমনি কালামের দুকানে খাবে। বিক্রি নিয়া কালামের চিন্তা
করা লাগবে না। বেশ বিশ্বাসের সাথে কথাটা বলল কালাম ভাই।
মেয়েটার হাসি যেন
মুক্তাঝরা। যখন ভাত মুখে নিয়ে খিলখিল করে হাসছে তখন দাঁতগুলো সব বের হয়ে যাচ্ছে। একটুও
কদাকার লাগছে না। অনেক সময় ভাত গিলে একটু থেমে তারপর হাসছে। ওদের চারজনের মধ্যে একটি
ছেলে অনেক হাসির কথা বলছে। জোকস করছে। সময় সময় হাসিতে মেয়েটির দম ঠেকে যাচ্ছে। পানি
খেয়ে আবার হাসছে। আমরা বেশ মজা নিচ্ছি।
শব্দ করে হাসলে বেশিরভাগ
মেয়েদের ভালো লাগে না। এই মেয়েটাকে লাগছে। যত শব্দ করে হাসছে তত ভাল লাগছে। তাদের হাসির
আড্ডা প্রায় শেষের পথে। প্লেটের ভাত ফুরিয়ে এসেছে।
একটা কুকুর এসে তাদের
পাশে একটু দূরে পেছনের দু’পা গুটিয়ে সামনের দু'পা খাড়া করে বসে পড়ল। মাটিতে ঘেঁষে লেজ নাড়াচ্ছে। ধুলো উড়ছে।
তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। খাওয়া শেষ। হাড়গোর কিছু তার ভাগে থাকার কথা। ওরা কুকুরটাকে
খেয়াল করলো। কৌতুককারী ছেলেটি তখনো তার সুন্দরী বান্ধবীকে হাসিতে মশগুল রাখতে ব্যস্ত।
ছেলেটি কৌতুকের এক পর্যায়ে প্লেটের কোণায় রাখা একটা মরিচ নিয়ে কুকুরের সামনে একটু দূরে
ফেলে দিল। কুকুরটি লেজ নাড়াতে নাড়াতে দৌড়ে খেতে গেল। গিয়ে দেখল মরিচ। কুকুরটি আগের
জায়গায় ফিরে এসে দু'পায়ে ঠেস দিয়ে আবারো
বসে পড়লো। মেয়েটি কুকুরের এই ঠক খাওয়া দেখে বেশ আনন্দিত হলো। ছেলে বন্ধুটি আবার লম্বা
এক দারুচিনি ফেলে দিল প্লেট থেকে। কুকুরটি আবার লাফিয়ে পড়লো। পরেরবার আবার অন্য কিছু
দিল, কুকুরটি শেষবারের মত হামলে
পড়ল ছেলেটির ছুঁড়ে দেয়া খাবারের উপর। বেচারা আবারো ঠক খেলো। এদিকে মেয়েটি হাড্ডি খাওয়ার
জন্য কুকুরের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে পাগল প্রায়। এখন মেয়েটিকে কেন জানি- আলিফ লায়লার
সোফানিজবার মত লাগছে। সোফানিজবা যত রুপবানই হোক না কেন, হাসিতেও সে ভয়ংকর!
ওদের দলের আরেকটি
যে মেয়ে ছিল সে এবার কথা বলে উঠলো। তোর পাতে হাড্ডি নাই তো এরকম করছিস কেন? থাম,
আমার
আছে। বলে মেয়েটি তার পাতের মাংসের টুকরা থেকে মাংস ছাড়িয়ে হাড্ডিটা কুকুরের দিকে ছুঁড়ে
দিল।
কুকুর লেজ নাড়াচ্ছে।
এবার সে হামলে পড়েনি। তবে হাড্ডি পেয়েছে। খাচ্ছে। কটমট করে।
এই মেয়েটি রুপবতী
নয়। এতক্ষণ ওর দিকে কারো চোখ যায়নি। ওখানে আরেকটা মেয়ে যে বসে ছিল সেটা শুধু ঠাহর করতে
পেরেছিলাম। এর বেশি না। মেয়েটিকে এখন বেশ রুপবতী দেখাচ্ছে। কুকুরটি খাচ্ছে আর মেয়েটির
চোখে মুখে রাজ্যের রাগ।
প্রাক্তন সুন্দরি
এখনো হাসছে। অট্টহাসি। আমার বন্ধু আর বড় ভাই দুজনে মুগ্ধ চোখে মেয়েটির হাসি দেখছে।
এবারের হাসি কুকুরের ঠক-জিতের জন্য নয়। তার বান্ধবীর সরলতার জন্য। যেন, হাড়টা কুকুরকে দেয়ার থেকে নিজে চিবিয়ে খেলেও
অনেক মজা পেত সে।
মাকাল ফল সুন্দর, ডালিমও সুন্দর। একটাকে ভাংলে বমি আসে, আরেকটাতে চোখ জুড়িয়ে যায়।
আমি ঘাড় কাত করে
প্লেটে মনযোগ দিলাম। খাবার প্রায় শেষ। মাংসের টুকরাটা রেখে দিয়েছি। সবশেষে খাবো। খাবার
শেষ করে মাংস চিবালে মুখে স্বাদ লেগে থাকবে। অনেক্ষণ পরেও মনে হবে আজ দুপুরে মাংস খেয়েছিলাম।
ভাল অনুভূতি হবে। পেট চোঁ চোঁ করলে বুঝবো- এ ক্ষুধা নয়, মনের ভুল। মাংস খেয়েছি। হজম হতে তো টাইম লাগবে।
টুকরাটা ধরতে যাবো
এমন সময় একটা পাখি আমার প্লেটে টয়লেট করে দিল। টুপ করে খালি প্লেটে মল পড়ে ছিটিয়ে গেল।
আমি সোজাসুজি ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালাম। মাথার উপরে ডানদিকে ছোট্ট একটা টিনের
সাইনবোর্ড। ইংরেজিতে বড় হাতের অক্ষরে ‘কে এফ সি’ লিখা। ছেলেমেয়েরা টাকা তুলে সাইনবোর্ডটা
কালাম ভাইকে বানিয়ে দিয়েছে। আদর করে কালাম ভাইয়ের পলিথিনের ছেঁড়া ছাউনির দোকানের নাম
দিয়েছে ‘কালামস ফুড কর্ণার।’
এখন ইয়াকুব নেই।
তাই আর রান্না হয় না। অনেকদিন যাবত এভাবে এখানে সেখানে খেয়ে বেড়াচ্ছি। ইয়াকুব থাকলে
রুমে খেতাম। কালাম ভাইয়ের দোকানে এমন কাকের মলের ছিটানি খেতে হতো না।
নতুন রুমমেট এসেছে।
মহা ব্যস্ত। কেমিস্ট্রিতে পড়ে। সারাদিন ল্যাব আর টিউশনি। কোথায় খায় তাও জানি না। শুধু
রাতে ঘুমুতে আসে। আর সকালে চলে যায়। পুরা যান্ত্রিক ছেলে একটা।
গত মারামারির ছুটি
ছিল প্রায় দু'মাস। সেই যে ইয়াকুব
বাড়ি গেল, আর আসেনি। একদিন একরামুল
স্যারের সাথে রাস্তায় দেখা। স্যার আমাকে ডেকে বললেন, তুমি ইয়াকুবের রুমমেট না?
আমি বললাম, জি স্যার।
ইয়াকুব আর পড়ালেখা
করবে না। ওর তেমন আত্মীয় স্বজন নেই। ওর মা টা যদি মরে যেতো তাও ছেলেটাকে আমি বাসায়
এনে রাখতাম। মরেওনি। আমি কিভাবে মায়ের কাছ থেকে এ অবস্থায় ছেলেটাকে নিয়ে আসি। লাখ দুয়েক
টাকা দিয়ে ওকে একটা ইলেকট্রিক এর দোকান করে দিয়েছি। এখন দোকানদারি করে। মায়ের ঔষুধ
পত্র কিনে সংসার চলে কোন রকমে। ওর জিনিষপত্রগুলো হল থেকে নিয়ে যেতে বললাম। বলল, আনার মত তেমন কিছু নাই। আসতে যেতে যা ভাড়া যাবে
তাতে ওর খরচও টিকবে না। ওর যা কিছু আছে প্যাকেট করে তুমি নিয়ে নিও। আর ইয়াকুবের হয়ে
হলের সিটটা ক্যান্সিল করে দিও। আমি প্রভোস্ট স্যারকে বলে দিবোনি।
এদিকে মোমিনের পুকুরটা
নিয়ে একটা মেস বানিয়ে দিয়েছি। মেসের পুরো কাজ এখনো শেষ হয়নি। নিচতলাটা কেবল সারা হয়েছে।
দেয়ালে রঙ করার কাজ এখনো বাকি। পুরো বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ না হলে রঙ করা যাচ্ছে না। এর
মধ্যে ছাত্ররা উঠা শুরু করেছে। তবে তেমন ভালো ইনকাম এখনো শুরু হয়নি। তাও খরচ বাদ দিয়ে
মোমিনের মাসে ২০ হাজার টাকা থাকে। আমি এখনো টাকা নেইনি। মেসটা পুরোদমে চালু হয়ে গেলে
তখন দেখা যাবে। ইয়াকুব ছেলেটা আসলে ওর পড়াশোনার খরচ এখান থেকে আরামে চলে যেত।
স্যারের সাথে সালাম
বিনিময় করে সেদিন বিদায় হলাম। নতুন রুমমেট আসার পর ইয়াকুবের জিনিষপত্রগুলো গুছিয়ে রেখেছিলাম।
যখন গুছাতে যাবো তখন আমার চোখ যেন ডিএসএলআর ক্যামেরা হয়ে গেল। ইয়াকুবের আচারের বয়োমটা
চোখের সামনে সাবজেক্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চারপাশের সবকিছু মূহুর্তেই ব্লার হয়ে গেল।
এই বয়োমে এখনো অর্ধেকের মত আচার আছে। খেয়ে শেষ করা ঠিক হবে না। এবার গরমের ছুটিতে ইয়াকুবের
বাড়ি গিয়ে চুপ করে বয়োমটা আন্টির ঔষুধের টেবিলে রেখে আসবো। আন্টির প্যারালাইজড হাত
তো আর কোনদিন আচার বানাতে পারবে না। পারলে গলা টিপে মরে যাবে। মা হলে কী হবে? এখন তার মৃত্যুর উপর দাঁড়িয়ে আছে সন্তানের জীবন।
ক্যাম্পাসে মাঝেমাঝে
বীথীর সাথে দেখা হয়। বীথী এখন আগের চেয়ে অনেক স্মার্ট হয়েছে। সুন্দর জামাকাপড় পরে।
ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়। চোখে কাজল দেয়। কপালে টিপ পরে। মুখে হালকা মেকাপও করে। সব সময়
হাসিহাসি থাকার ট্রাই করে। আমার সাথে দেখা হলে মৃদু দাঁত বের করে হাসি মুখে বেশ সৌজন্যতা
নিয়ে বলে, ভাইয়া কেমন আছেন?
আমি অবশ্য ইনফরমালি
বলার চেষ্টা করি- এইতো বীথী, ভালো। তুমি কেমন
আছো?
সমাপ্ত...
প্রিয় পাঠক, অনেক ধন্যবাদ আর ভালোবাসা উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য!